সে ছিল আমাদের সোনালি বিকেলের দিনকাল। সিনেমার হিরোরা বুকের মধ্যে তুফান তুলতেন। হিরোইনরা আঁখিয়োসে গোলি মারতেন। পান সিগারেটের দোকানে নিষিদ্ধ সিনেম্যাগের প্রচ্ছদ থেকে মোহিনী দৃষ্টিতে থাকিয়ে থাকতেন রাংতা পোশাকে জুহি, খালি গায়ে সালমান, হৃদয়ভোলানো হাসিতে মাধুরী, ছেঁড়া স্যান্ডো গেঞ্জিতে অক্ষয়। বাজিগরের জন্য তখন স্কুলে অনেকেই দিওয়ানা। এইসব বয়ঃসন্ধির ক্রান্তিকালে অনেকেই একটু আধটু মৌলবাদী হয়ে উঠতাম। আমার থাকবে সালমান মাধুরী, আর কেউ না। সবচেয়ে কাছের ইয়ার অক্ষয়কুমার লবি। দু’জনে ফাটাফাটি ঝগড়া করছি প্রেয়াররুমে না গিয়ে, সালমান না অক্ষয়, হাম আপকে হ্যায় কৌন না ম্যায় খিলাড়ি তু আনাড়ি এই বিতর্কে, ফলতঃ সারা ক্লাস কঠোর শাস্তি পেয়েছে, তাও আমাদের চুলোচুলি কমেনি একরত্তি। অনেকে ছিল নাকি শাহরুখ দিওয়ানা, কিন্তু তাঁকে নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি করার মত দিওয়ানা তখনও গোকুলে বাড়ছে।
বাবরি মসজিদ ইতিহাস পরবর্তী সময়। আমাদের চেতলার অহীন্দ্র মঞ্চ তখন সদ্য থিয়েটার শিকেয় তুলে সিনেমা হল হয়েছে। বাসি হিন্দি সিনেমা রিলিজ হত, কখনও ইংরেজির ডাবিং। আজ দামিনী তো কাল ঘাতক। লোকে হুমড়ি খেয়ে লাইন দিয়ে টিকিট কেটে হাউসফুল করে দিচ্ছে। তখনও কেবল চ্যানেল কতিপয় ঘরেই থাকত, বেশীর ভাগের তখনও অ্যান্টেনায় কাক, আমি তো অবাক দূরদর্শন উইথ রুকাওট কে লিয়ে খেদ হ্যায় সাদা কালো মিহিদানা। এমন গরীব এক সন্ধেয় অহীন্দ্র মঞ্চে বাজিগর দেখতে গিয়ে শাহরুখের সঙ্গে ভালো করে আলাপ। কি তুমুল থ্রিল! এক একটা নির্দোষ ছেলে-মেয়েকে এক এক করে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিচ্ছেন ক্রূর কটা দৃষ্টির শাহরুখ, আর তাঁর জন্য সিমপ্যাথিতে আঙুলের সবকটা নখ খেয়ে ফেলছি। ওভার পজেসিভ, আপাদমস্তক ঠগ, একটা ক্রিমিনাল রেড ফ্ল্যাগওয়ালা হিরোর ক্লাইম্যাক্সে কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছি। সিনেমা শেষে হল থেকে বেরিয়ে হতভম্ব ভাব কাটতে বেশ সময় লেগেছিল। পরের বেশ কিছুদিন অক্ষয়লবির দোস্তের সঙ্গে আর ঝগড়া করিনি। পুজো প্যান্ডেলে এক দুজে কে ওয়াস্তে বেজেছে, শুনে অকারণ ব্লাশ করেছি।
এর পর সোনালি আলো মুছে সাঁঝ নেমেছে আজ কমদিন হল না। সিনেমা আস্তে আস্তে মুভি হয়েছে। দিওয়ানা বাজিগর বহু বাজি হেরে জিতে বুড়ো ঘোড়া থেকে বাদশার পথ অতিক্রম করে চলেছেন।
দর্শনধারী সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের আঙুলের ডগায় নেচে চলেছে কটুক্তি, অপমান, ঘৃণা। একদা বিশ্বসুন্দরী ঐশ্বর্যও আজ বডি শেমিংয়ের খোরাক হয়ে যাচ্ছেন।
অস্বস্তিকর চল্লিশায় এসে মন খারাপের কর্মনাশা সন্ধেয় রাতে কখনও গার্ড নেমেই যায়। তখন না চাইতেই তাঁর দেখা পাই। সহকর্মী, স্ত্রী, কন্যা, মেয়েদের একটু বেশী আগলে রাখা শাহরুখের রীল, দুর্দান্ত টেড টকের ক্লিপ, কিংবা একেবারে সেইসব সোনালি আলো আলো দিনের নস্টালজিয়া ফেরানো উদিত, শানু, লতা, অলকার মায়াকণ্ঠে তাঁর টোল ফেলা হাসির যুগলবন্দী। বাচনে, দৃষ্টিতে আশ্চর্য ভালোবাসার উত্তাপ রেখে যাওয়া শাহরুখ ক্যামেরা অন হলে স্ক্রিপ্ট মেনে অভিনয়টাই করেন। কিন্তু সেই অভিনয় মন ভালো করে দেয়, আলো করে দেয়। আর সব গ্লানির মত বাজিগরের প্লটে সিমপ্যাথি ঢালার অপরাধবোধ খানিক হালকা হয়। মনে পড়ে, বিদেশ বিঁভুইয়ে ইংরাজি না জানা হোটেলে আমার গায়ের রং দেখে এশীয় ওয়েটার একগাল হেসে বলেছেন, “বলিউদ? সালুখ খান? ইন্দিয়া?”, হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন একগাদা নুন মরিচের স্যাশে। তাঁর সাধ্যমত উপহার। শাহরুখের হয়ে হাত পেতে সেসব নিয়ে ফিরেছি ঘরে।
শাহরুখে যদি এই সাঁঝবেলায় একটি ভালোবাসার দেশ খুঁজে পাওয়া যায়, তাই বা কম কী?