কথকতার ছলে জীবনের গল্প বলে মেয়েদের দল Mad Balikas
পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় | প্রকাশিত: 02 নভেম্বর 2024

সে ছিল আমাদের সোনালি বিকেলের দিনকাল। সিনেমার হিরোরা বুকের মধ্যে তুফান তুলতেন। হিরোইনরা আঁখিয়োসে গোলি মারতেন। পান সিগারেটের দোকানে নিষিদ্ধ সিনেম্যাগের প্রচ্ছদ থেকে মোহিনী দৃষ্টিতে থাকিয়ে থাকতেন রাংতা পোশাকে জুহি, খালি গায়ে সালমান, হৃদয়ভোলানো হাসিতে মাধুরী, ছেঁড়া স্যান্ডো গেঞ্জিতে অক্ষয়। বাজিগরের জন্য তখন স্কুলে অনেকেই দিওয়ানা। এইসব বয়ঃসন্ধির ক্রান্তিকালে অনেকেই একটু আধটু মৌলবাদী হয়ে উঠতাম। আমার থাকবে সালমান মাধুরী, আর কেউ না। সবচেয়ে কাছের ইয়ার অক্ষয়কুমার লবি। দু’জনে ফাটাফাটি ঝগড়া করছি প্রেয়াররুমে না গিয়ে, সালমান না অক্ষয়, হাম আপকে হ্যায় কৌন না ম্যায় খিলাড়ি তু আনাড়ি এই বিতর্কে, ফলতঃ সারা ক্লাস কঠোর শাস্তি পেয়েছে, তাও আমাদের চুলোচুলি কমেনি একরত্তি। অনেকে ছিল নাকি শাহরুখ দিওয়ানা, কিন্তু তাঁকে নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি করার মত দিওয়ানা তখনও গোকুলে বাড়ছে।

বাবরি মসজিদ ইতিহাস পরবর্তী সময়। আমাদের চেতলার অহীন্দ্র মঞ্চ তখন সদ্য থিয়েটার শিকেয় তুলে সিনেমা হল হয়েছে। বাসি হিন্দি সিনেমা রিলিজ হত, কখনও ইংরেজির ডাবিং। আজ দামিনী তো কাল ঘাতক। লোকে হুমড়ি খেয়ে লাইন দিয়ে টিকিট কেটে হাউসফুল করে দিচ্ছে। তখনও কেবল চ্যানেল কতিপয় ঘরেই থাকত, বেশীর ভাগের তখনও অ্যান্টেনায় কাক, আমি তো অবাক দূরদর্শন উইথ রুকাওট কে লিয়ে খেদ হ্যায় সাদা কালো মিহিদানা। এমন গরীব এক সন্ধেয় অহীন্দ্র মঞ্চে বাজিগর দেখতে গিয়ে শাহরুখের সঙ্গে ভালো করে আলাপ। কি তুমুল থ্রিল! এক একটা নির্দোষ ছেলে-মেয়েকে এক এক করে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিচ্ছেন ক্রূর কটা দৃষ্টির শাহরুখ, আর তাঁর জন্য সিমপ্যাথিতে আঙুলের সবকটা নখ খেয়ে ফেলছি। ওভার পজেসিভ, আপাদমস্তক ঠগ, একটা ক্রিমিনাল রেড ফ্ল্যাগওয়ালা হিরোর ক্লাইম্যাক্সে কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছি। সিনেমা শেষে হল থেকে বেরিয়ে হতভম্ব ভাব কাটতে বেশ সময় লেগেছিল। পরের বেশ কিছুদিন অক্ষয়লবির দোস্তের সঙ্গে আর ঝগড়া করিনি। পুজো প্যান্ডেলে এক দুজে কে ওয়াস্তে বেজেছে, শুনে অকারণ ব্লাশ করেছি।

এর পর সোনালি আলো মুছে সাঁঝ নেমেছে আজ কমদিন হল না। সিনেমা আস্তে আস্তে মুভি হয়েছে। দিওয়ানা বাজিগর বহু বাজি হেরে জিতে বুড়ো ঘোড়া থেকে বাদশার পথ অতিক্রম করে চলেছেন।

দর্শনধারী সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের আঙুলের ডগায় নেচে চলেছে কটুক্তি, অপমান, ঘৃণা। একদা বিশ্বসুন্দরী ঐশ্বর্যও আজ বডি শেমিংয়ের খোরাক হয়ে যাচ্ছেন।

অস্বস্তিকর চল্লিশায় এসে মন খারাপের কর্মনাশা সন্ধেয় রাতে কখনও গার্ড নেমেই যায়। তখন না চাইতেই তাঁর দেখা পাই। সহকর্মী, স্ত্রী, কন্যা, মেয়েদের একটু বেশী আগলে রাখা শাহরুখের রীল, দুর্দান্ত টেড টকের ক্লিপ, কিংবা একেবারে সেইসব সোনালি আলো আলো দিনের নস্টালজিয়া ফেরানো উদিত, শানু, লতা, অলকার মায়াকণ্ঠে তাঁর টোল ফেলা হাসির যুগলবন্দী। বাচনে, দৃষ্টিতে আশ্চর্য ভালোবাসার উত্তাপ রেখে যাওয়া শাহরুখ ক্যামেরা অন হলে স্ক্রিপ্ট মেনে অভিনয়টাই করেন। কিন্তু সেই অভিনয় মন ভালো করে দেয়, আলো করে দেয়। আর সব গ্লানির মত বাজিগরের প্লটে সিমপ্যাথি ঢালার অপরাধবোধ খানিক হালকা হয়। মনে পড়ে, বিদেশ বিঁভুইয়ে ইংরাজি না জানা হোটেলে আমার গায়ের রং দেখে এশীয় ওয়েটার একগাল হেসে বলেছেন, “বলিউদ? সালুখ খান? ইন্দিয়া?”, হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন একগাদা নুন মরিচের স্যাশে। তাঁর সাধ্যমত উপহার। শাহরুখের হয়ে হাত পেতে সেসব নিয়ে ফিরেছি ঘরে।

শাহরুখে যদি এই সাঁঝবেলায় একটি ভালোবাসার দেশ খুঁজে পাওয়া যায়, তাই বা কম কী?

আপনার মতামত

এর উত্তরে Some User

এই বিভাগের অন্যান্য পোস্টসমূহ

  • চা

    পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় | প্রকাশিত: 21 মে 2024

    কেটলিতে আধহেমন্তের সকাল বুড়বুড়ি কাটছে। ঐ ঘাড়ে ঘাড়ে জোলো দুধ আর চিনির ডেলা পড়ল। রং দেখ, যেন সাক্ষাৎ মে মাসের দুপুর। সামান্য শিউরে উঠলেন সাঁপুইবাবু। হাতে হাতে পাচার হয়ে যে ভাঁড়টা এসে পৌঁছল তার খোঁদলে উষ্ণ তরলের ওপর পুরু সর। তাও মুখ দেখার ব্যর্থ চেষ্টা তিনি করবেনই। রোজকার মতন। রিফ্লেক্স।

  • একশো উত্তম

    পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় | প্রকাশিত: 24 জুলাই 2024

    উঁহু। এ ছবি দেখার মত দৃষ্টিদান আমাকে তো কেউ করে নি। ও আমি কামনাও করিনে। মর্যাদা বলে তো একটা ব্যাপার আছে না কি? ঐ থোবড়া দেখে গোটা বসু পরিবার দিওয়ানা হয়ে গেল, সে কার পাপে বলে দিতে হবে? মুরোদ সাড়ে চুয়াত্তর পয়সার, আর রোয়াব লাখ টাকার। বৌ ঠাকুরাণীর হাটে বেচে দাও না, ঠেলে উঠবে মরণের পারে। যদিও ওরা থাকে ওধারে, তাও তো চাঁপাডাঙার বৌটাকে ঝাড়ি মারে এন্তার। হাবভাব এমন, উনি অন্নপূর্ণার মন্দির বানিয়ে অগ্নিপরীক্ষা দিচ্ছেন যেন।

  • কালো মেয়ে

    ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য | প্রকাশিত: 25 অক্টোবার 2024

    দুপুরবেলা পড়তে বসে অংকে ভুল হয়ে যায় মেয়ের, মুঠো খানেকের হৃৎপিন্ডে ছলকে ওঠে রক্ত, বেণীমাধবকে দেখে একদৌড়ে সে পালিয়ে যায় ঘরে। বেণীমাধব, লেখাপড়ায় ভালো, শহুরে, দেখতেও বুঝি রাজপুত্তুরটি।

    কিন্তু, মেয়েটির গায়ের রং যে কালো?

  • আহু দারিয়েই

    পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় | প্রকাশিত: 07 নভেম্বর 2024

    আহু দারিয়েই বলে আসলে কিছু নেই।

    বিশ্বাস হচ্ছে না? আপনি বলবেন ভাইরাল হয়েছিলেন আহু দারিয়েই। আপনি বলবেন হিজাব ছাড়া দুই সন্তানের জননী আহু দারিয়েই তেহরানের ইসলামী আজাদ ইউনিভার্সিটিতে পড়তে এসেছিলেন। পর্দা না করার মত গুনাহ ওখানকার মাতব্বরেরা মোটেও কবুল করেননি। তাঁরা এসে তরুণীকে উত্তম মধ্যম দিয়ে তার ঊর্ধ্বাঙ্গের পোষাক কেড়ে তাঁকে ক্ষমা করে ছেড়ে দেন।

  • ঈদ মোবারক নাসিম

    ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য | প্রকাশিত: 30 মার্চ 2025

    নাসিম, কেমন আছিস?

    আজ ঈদ। ঈদের অকুন্ঠ শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা নিস। আমিও নিলাম। নিয়ে দিয়ে কিছু অতিরিক্ত রয়ে গেলে সেই ভালোবাসায় চল হরির লুট দিই। আমার দিদুন দিতেন তুলসীতলায় দাঁড়িয়ে। তোর নানা সাহেব যেমন যাকাতুল ফিতর দিতেন, রমজানের শেষে।

  • গুরু প্রণাম

    ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য | প্রকাশিত: 30 নভেম্বর 2024

    তেত্রিশ বছর আগের কথা। ক্লাস ফাইভে আমার প্রথম দিন, গরমের ছুটি পড়বে ঠিক তার পরদিন থেকে। নতুন স্কুলেও সেদিনই আমার প্রবেশ, মহারাষ্ট্র থেকে সদ্য এসেছি কলকাতায়, কথায় কথায় হিন্দি মারাঠি 'ঘুসে' যায় তখনও। মা বাবা ভর্তি করে দিলেন স্থানীয় ইশকুলে। রবীন্দ্র বালিকা বিদ্যাপীঠ, বাংলা মাধ্যম, সবুজ স্কার্ট শাদা শার্ট। তবে সেইদিন ছিল রঙ্গিন পোষাকের দিন, গরমের ছুটি পড়ে যাবে এর পর।

  • কুত্তা বিল্লি ফ্রী

    পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় | প্রকাশিত: 16 আগস্ট 2025

    একটু ইউটোপিয়ার কথা হোক? হ্যাঁ? বেশি না, বছর তিনেক পরে।

    দিল্লি কলকাতা মুম্বাই এখন স্পটলেস ক্লিন। যেদিকে তাকাবেন নো সাইন অফ নেড়ি কুত্তা। কর্পোরেশন সব তুলে সাফ করে দিয়েছে। এখন কুত্তা মানেই বকলস দেওয়া বিলিতি হাইব্রিড। বেশিদিন বাঁচেও না, ইনস্টা স্টোরি ফোরি রিল ফীল হয়ে যাচ্ছে এটাই শান্তি।

  • গ্রে স্কেল চার

    পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় | প্রকাশিত: 24 জুলাই 2025

    সেও এক দিন ছিল!

    ষাটের শেষ, কিংবা সত্তরের শুরু। উঠতি বয়সের সিড়িঙ্গে এক ছোকরা চায়ের দোকানে বিড়ি ফুঁকছে। যেমন ধারালো মুখ তেমন ধারালো জিভ। ফাঁকিবাজ আবার পরোপকারী বলে দুর্নাম। এর বাপকে নালিশ দেবার সাহস কার আছে? মহেশ বাঁড়ুয্যে ডাকসাইটে পণ্ডিত। মামুলি সরকারী চাকুরে হতেই পারেন, কিন্তু খড়ম, সংস্কৃত আর অঙ্কে গায়ত্রী জপেন। তাঁর মেজ ছেলে এমন মারকুটে দুর্মুখ ধারা কোথা থেকে পেলে কেউ জানে না।