তেত্রিশ বছর আগের কথা। ক্লাস ফাইভে আমার প্রথম দিন, গরমের ছুটি পড়বে ঠিক তার পরদিন থেকে। নতুন স্কুলেও সেদিনই আমার প্রবেশ, মহারাষ্ট্র থেকে সদ্য এসেছি কলকাতায়, কথায় কথায় হিন্দি মারাঠি 'ঘুসে' যায় তখনও। মা বাবা ভর্তি করে দিলেন স্থানীয় ইশকুলে। রবীন্দ্র বালিকা বিদ্যাপীঠ, বাংলা মাধ্যম, সবুজ স্কার্ট শাদা শার্ট। তবে সেইদিন ছিল রঙ্গিন পোষাকের দিন, গরমের ছুটি পড়ে যাবে এর পর।
ক্লাসরুমেই একটা গান নাচের অনুষ্ঠান হচ্ছিল। মেয়েরা করছে। আমি সবে নতুন, তাই কেবল দর্শক। একেবারে সামনের বেঞ্চে বসে। মহারাষ্ট্রে বলতাম 'টিচার' এখানে 'দিদিমণি' বলতে শুনি। একজন দিদিমণি ঘরেই ছিলেন, খানিক পরে আর একজন দিদিমণি এলেন। ধবধবে গায়ের রঙ, ছোট্টখাট্ট চেহারা, চলনে এক আশ্চর্য তৎপরতা,অস্হিরতা নয়। অনেক পরে জেনেছি আধুনিক কেজো দুনিয়া একে বলে agility. কিন্তু সবার ওপরে যা ছিল, তা হল একজোড়া আশ্চর্য চোখ।
হাসিমুখে খানিকক্ষণ ছাত্রীদের অনুষ্ঠান দেখে ছুটি নিয়ে বোধহয় কিছু ঘোষণা করলেন, ভালো মনে নেই। তবে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় একপলক আমার দিকে চাইলেন, তারপর বললেন - এভাবে পায়ের ওপর পা তুলে বসবে না। আর একজনের দিকে পা তুলে থাকলে তাকে অসম্মান করা হয়।
গলা তুললেন না, কঠিন কোনও শব্দ ব্যবহার করলেন না, তবু এমন এক অলঙ্ঘ্য নির্দেশ করে গেলেন, গোটা জীবন আমি তা পেরোতে পারলাম না।
ইনি মলিনা দিদিমণি। আমাদের রবীন্দ্র বালিকা বিদ্যাপীঠের তৎকালীন টিচার-ইন-চার্জ মলিনা রুদ্র।
আমাকে এই স্কুলে ভর্তি করানো নিয়ে বহু আপত্তি করেছিলেন আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব পাড়া প্রতিবেশি সকলেই। একে মফস্বলের বাংলা মাধ্যম, তায় অত্যন্ত সাধারণ মানের ফলাফল হয় মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিকে। হবে নাই বা কেন, কারা পড়তে আসে সেখানে? বেশির ভাগ সেই সব মেয়ে, যাদের অভিভাবকেরা নেহাতই নিয়ম রক্ষার জন্য মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করেন, পাশ-ফেল ইত্যাদিতে তেমন বিচলিত হ'ননা। টেনেটুনে ষোলো কি আঠারো অবধি পড়িয়ে নিলেই হল। লেখাপড়া জানা মেয়ের বিয়ে দেওয়া সহজ হয়। ফলে বাজারের পরিচিত মাপকাঠিতে তাদের মেধা আলাদা করে খুব গুরুত্ব পায় না।
তেমন একখানি ইশকুল আমার মা-বাবা আমার জন্য বেছেছিলেন বাড়ি থেকে ন্যূনতম দূরত্ব হিসেব করে। নইলে মধ্যবিত্ত সচ্ছলতা ততদিনে স্হানীয় ইশকুল, তায় বাংলামাধ্যম, এসব সন্তর্পণে এড়িয়ে গিয়ে ইংরেজি মাধ্যম এবং প্রাইভেট ব্যবস্থার দিকে যেতে শুরু করে দিয়েছে।
আমাদের ইশকুলের শিক্ষক শিক্ষিকারাও তাঁদের নিজস্ব কর্মক্ষেত্রের বদলে সন্তানদের জন্য তথাকথিত নামজাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই ভরসা রেখেছিলেন।
এক ব্যতিক্রম, মলিনা রুদ্র। উচ্চশিক্ষিত এবং যারপরনাই আলোকপ্রাপ্ত ঐ রুদ্র পরিবার তাঁদের দুই মেয়েকেই শাদা ব্লাউজ সবুজ স্কার্ট পরিয়ে গড়পড়তা স্হানীয় স্কুলটিতে পাঠাতে দ্বিধা করেননি। সেই ছাত্রীদুটি মেধাজগতে ঠিক কতখানি উচ্চতায় পৌঁছেছেন, সে কথা আজ নয়, আরেকদিনের জন্য থাক। আজ কথা সেই ছোট্টখাট্ট চেহারার বিরাট মানুষটির যিনি না থাকলে আমি, আমার মতো আরও না জানি কতজন, এক সুছাঁদ বাস্তবতার জীবন পর্যন্ত হয়ত পৌঁছতেই পারতাম না।
আগেই বলেছি এই স্কুলের অধিকাংশ ছাত্রীর তেমন কোনও উচ্চকাঙ্খী অভিভাবক ছিলেন না, অর্থনৈতিক কারণে তো বটেই, কখনও সামাজিক কারণেও। তাই বোধহয় সব উচ্চাকাঙ্খার দায় একাকাঁধে তুলে নিয়েছিলেন ঐ মানুষটা, মলিনা দিদিমণি। এই তো ক'টাবছরের খামখেয়ালি কৈশোর, তারপরেই তো আজীবন হেঁশেলে জুতে দেবে মেয়েগুলোকে। কেউ কি আর পিঠ ঠুকে বলবে, দারুণ করেছিস!
কোনওদিন কেউ কিছুর জন্য প্রাইজ, মেডেল দেবে? হাততালি? সামান্য প্রশংসা বাক্যও কখনও জুটবে? মাথায় হাত রেখে সামনে এগিয়ে যেতে আশীর্বাদ করবে?
বড় অনিশ্চিত সে সব। তাই তিনি এক আশ্চর্য বস্তুর খোঁজ করে চলতে থাকেন।
সুযোগের খোঁজ।
নিজের জন্য নয়। ঐ তাদের জন্য, যাদের আম আদমীর সুশীল সমাজ আমঔরত কথাটার স্বীকৃতিও দেবে না।
তাদের জন্য তিনি যেন পাতাল ফুঁড়ে, আকাশ চিরে নিয়ে আসেন সুযোগ। আনন্দে, সাফল্যে সামিল হওয়ার সুযোগ। জেলা বা রাজ্যস্তরের নানা পরীক্ষার সুযোগ। নানা অনুষ্ঠানে, প্রতিযোগিতায় যোগদানের সুযোগ। স্কুলের গতানুগতিক সিলেবাসের মধ্যে অপূর্ব সব চমকের সুযোগ। মেয়েগুলো যেন খানিক ছুটতে শেখে, খানিক উড়তে শেখে, খানিক লড়তে শেখে, এবং অনেটা জিততে শেখে।
বড় হয়ে বুঝেছি, আমাদের তথাকথিত পিছিয়ে থাকা বালিকা বিদ্যালয়ের অতিসীমিত পরিকাঠামো থেকে সেই সব ঘটিয়ে তোলা এক জনের পক্ষে অবাস্তব। অসম্ভব। তাই আমার জবর বিশ্বাস, যে মলিনা রুদ্র একা একশোজনেরও অধিক, বরাবর।
Women empowerment, child rights - এ সব কাগজের লেখায় পড়েছি অনেক পরে, মলিনাদিকে দেখেছি সেই কবে থেকে! কার স্বামী ছেড়ে চলে গেছে, খাওয়া জোটে না, তিনি সেলাই মেশিনের ব্যবস্হা করে দেন। সঙ্গে বিক্রির বাজারও ধরিয়ে দেন। কাউকে বসিয়ে দেন ছোটখাট অফিসে, কারুর জন্য হোম ডেলভারির বন্দোবস্ত পাকা করে দেন। হিসেব রাখতে শেখান অপরিসীম ধ্যৈর্যে। ভবিষ্যতের কথা ভাবতে শেখান পরম যত্নে। সঞ্চয় করগে শেখান সঠিক উপায়ে। মেয়েদের মায়েরা না দাঁড়ালে মেয়েরা এগোবে কি করে? এই এগিয়ে যাওয়ার আগ্রহেই স্কুলজীবনের অবসরের পর পুতুল বানানো শিখে ফেলেন, শিখে ফেলেন হাল ফ্যাশানের গয়না বানানোর পদ্ধতি, আরও কত কত কি!
- বসে থাকব! সে কি রে! তা ছাড়া কত মেয়ে আছে যাদের নিজের পায়ে দাঁড়ানো প্রয়োজন! আমাকে শিখে নিয়ে ওদের শিখিয়ে দিতে হবে না!
শুধু শেখানোতে থেমে থাকেন কি!
- কি যে বলিস! ওদের মূলধন জুটবে কোত্থেকে, আমি কিছু না দিলে? আজ আমি কিছু দিলে ওরাই একদিন দেখবি আর একজনকে দাঁড় করাচ্ছে।
বটেই তো! তিনি তো চ্যারিটিতে নয়, ইকোসিস্টেম তৈরিতে বিশ্বাসী।
সঙ্গে চলে ফুরসুত বিহীন পড়ানো। সকাল দুপর বিকেল সন্ধ্যা! দাপুটে অঙ্কের দিদিমণি, কি যেন সব জাদুমন্ত্র জানেন, দাঁতভাঙা সমীকরণ মুহূর্তে মাখন হয়ে যায়।
তাঁর আরও এক স্বত্ত্বা আছে, গান। অপূর্ব কন্ঠ, নিয়মিত রেওয়াজ করা অসামান্য গায়কী। রেডিওতে, টেলিভিশনে, উৎসবে, উদযাপনে, স্যোশ্যাল মিডিয়াতে প্রোগ্রাম করেন নিয়মিত।
সন্দেহ হয়, তাঁর দিনগুলোতে ঘন্টার কারচুপি আছে, নির্ঘাত কয়েক ঘন্টা বেশি গোঁজা থাকে। নইলে এতখানি ব্যপ্ত কি ভাবে থাকতে পারে কেউ?
অজস্র জীবন যেন অনায়াসে তাঁর ঐ একখানি জীবনের ভাঁজে ভাঁজে ঢুকে থাকে।
বাইরের জগতের দিদিমণি, শিক্ষক আর ঘরের জগতের মা স্ত্রী দিদা ঠাকুমা প্রতিবেশী - আরও কত কি।
কিন্তু প্রতিটি পরিচয়তেই তিনি তাঁর মতো চমৎকার! হয়ত চেনা ছবির খানিক বাইরে, কিন্তু চমৎকার! রোগশ্রান্ত স্বামীর চৈতন্য ধরে রাখার জন্য ডাক্তার যখন বলেন - আপনি যেভাবে পারেন চেষ্টা করুন, তখন তিনি সাতপাঁচ ভেবে শেষমেষ অঙ্কের ধাঁধা ধরতে শুরু করেন। কারণ তিনি জানেন, অঙ্কপাগল মানুষটি দুনিয়া ভুলে গেলেও ইউক্লিড বা আর্কিমিডিসকে অগ্রাহ্য করতে পারবেন না।
মলিনাদিকে দেখেছি আমরা। তাঁকে ছুঁয়ে বেড়ে উঠেছি পূর্ণ নারীজীবনে। কেসি নাগ, বসুমৌলিক ছাড়িয়ে পাঠ পেয়েছি বাঁচতে গেলে, বাঁচার মতো জীবন তৈরি করতে গেলে কোন কোন পরীক্ষায় নেমে পড়তে হয়। সেইসব পরীক্ষা একা একা দেওয়ার পরীক্ষা নয়। একসঙ্গে, অনেকের সঙ্গে চলতে হয়, সঙ্গে নিয়ে চলতে হয়। আজকের দিনে, ঠিক হাঙরের মত হাঁ করা এই সময়ে, দেখব, কতটা তৈরি হতে পেরেছি - ঐ দাঁতগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়ার মতো। বয়স বাড়ুক, কৈশোরের বেপরোয়া মেজাজটুকু অক্ষয় করে রাখার মন্ত্রগুপ্তিখানা তিনি শিখিয়ে দিয়েছেন অব্যর্থ উপায়ে।
মলিনাদি বরাবর বলেছেন বয়স একটা সংখ্যামাত্র। ঐ হাতের চামড়ায় ভাঁজ বাড়বে, তা বাড়ুক, আশীর্বাদের হাতখানা ওভাবেই থেকে যাক।