কথকতার ছলে জীবনের গল্প বলে মেয়েদের দল Mad Balikas
ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য | প্রকাশিত: 25 অক্টোবার 2024

দুপুরবেলা পড়তে বসে অংকে ভুল হয়ে যায় মেয়ের, মুঠো খানেকের হৃৎপিন্ডে ছলকে ওঠে রক্ত, বেণীমাধবকে দেখে একদৌড়ে সে পালিয়ে যায় ঘরে। বেণীমাধব, লেখাপড়ায় ভালো, শহুরে, দেখতেও বুঝি রাজপুত্তুরটি।

কিন্তু, মেয়েটির গায়ের রং যে কালো?

কালো মেয়ে, তায় বাপ গরীব, রাজপুত্তুর কি আর তার কপালে জোটে? আচ্ছা, কি এসে যায় রাজপুত্তুর না পেলে? মেয়েজন্মের সার্থকতা কি কেবল ঝকঝকে ঘর, তকতকে বর আর বকবকে বাচ্চা? না, না। তা কখনও হয়! তা তো বলেনি সে! সে বলেছে একটা ছোট্ট কাঁটার কথা। কোথায় যেন বিঁধতেই থাকে। অবিরাম।

আর ঐ কাঁটা তোলার ব্যবসাতেই পাখির চোখ দেখেন ঝোপ বুঝে কোপ মারার কারবারিরা। কোটি কোটি কালো কন্যের দুঃখ ঘোচাতে মঞ্চে নামেন কলির মধুসূদন হিন্দুস্হান লিভার কোম্পানি, হাতে সুদর্শন চক্রের বদলে একখানি নিরীহ ক্রিমভরা টিউব। ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি। বাজারে ঢুকতেই বাজিমাত।

সময়টা 1975। শহর ছেড়ে মফস্বল, মফস্বল ছেড়ে গ্রামে ঢুকতে এক দশকেরও কম সময় লাগে কোম্পানিটির। চোখের পলক ফেলতেই আয়নার তাকে ফিতে, কাজল, টিপের পাশে তো বটেই, ফেয়ার অ্যান্ড লাভলির টিউব হইহই করে ঠাঁই করে নেয় কনের তত্ত্বের ডালাতে, ভাইফোঁটার গিফটে, পকেটমানির বাজেটে। লাফিয়ে লাফিয়ে তার মুনাফা বাড়ে। আজ দু'হাজার কোটির ওপরে তার ব্যবসা। তা বাড়বাড়ন্ত হোক।। আমাদের কি!

মাঝে তারা হেব্বি সমাজ সচেতন ফচেতন হয়ে ব্র্যান্ডের নামও বদলেছিল। ফেয়ার নয় গ্লো। ফর্সা নয়, ফুটফুটে।

এরপর বেনোজলের মতো বাজারে ঢুকে পড়েছে অজস্র রূপটান কোম্পানি, বিউটি ক্লিনিক, মেক-আপ স্টুডিও।এদিকে সোশ্যাল মিডিয়ায় কোরিয়ান সুন্দরীদের আয়নাপিছল ত্বক একেবারে হুড়োহুড়ি ফেলে দিয়েছে বাজারে। ভালো ফোন মানে ভালো ক্যামেরা, এবং তার চাইতেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভালো ফিল্টার - দু এক পোঁচ গাঢ়তা অনায়াসে কমিয়ে দেওয়ার প্রযুক্তির চাহিদা যেন আকাশ ছোঁয়। এমনকি গর্ভজাত সন্তানকে ফর্সা প্যায়দা করার নানান ফিকিরও নাকি চড়াদরে চোরা পথে ঢুকে পড়ছে আজকাল একেবারে ঘরের ভেতরে। পরিসংখ্যান বলছে গত দুই বছরে ফর্সা হওয়ার রূপটানের বাজার বেড়েছে পনোরো শতাংশ বেগে। তার আগের দশ বছরে যার বৃদ্ধির হার ছিল ছয় শতাংশের আশেপাশে। এই মানে সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমির কথাই বলছি।

সেই জন্মভূমি যে কিনা আদর করে মাথায় করে রাখত তার কালো মেয়েদের। দারুণ বিপদে ডাক দিয়েছিল ঘোর কালো একটি মেয়েকে, ইতিহাসের পাতায় যদিও সে লড়াকু মেয়ের নাম নেই, কিন্তু এক বিপুল জনগোষ্ঠীর সামাজিক স্মৃতি থেকে তার খু*নরাঙানো পায়ের ছাপ মোছা যায়নি আজও।

আমরা মন্ত্রতন্ত্র জানিনা, জানতে চাইও না, এমনই আমরা অলম্বুষ। তবু ঐ কালো মেয়েটিকে নিয়ে এক দুই লাইন গান বেঁধে ফেলি, প্রাচীন কোনও উপজাতির নাম না জানা পূজারিণীদের করা কালীপুজোর শোলোক থেকে কথা সুরের প্রসাদ নিয়ে সাহস করে গেয়েও ফেলি, আরও অজস্র কালো মেয়ের কথা বলতে বলতে।

আসুন, সে সব কথা সকলে মিলে বলি। জোরে জোরে বলি। কান ফাটিয়ে বলি।

কেন? আরও যাঁরা এসব কথা বলে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে, তাঁদের ক্রমাগত কন্ঠের দাপটে নতুন প্রজন্ম নাকি সত্যিই ঝেড়ে ফেলতে শুরু করেছে ফর্সা রঙের বদ্ধ সংস্কার। প্রতিফলন পড়ছে বাজারে। ফর্সা হওয়ার পণ্যের বিক্রি গত বছর কমেছে তিন শতাংশ। আরও সাতানব্বই এর রাস্তা বাকি। দেখি কতটা পথ চলা যায়।

আপনার মতামত

এর উত্তরে Some User

এই বিভাগের অন্যান্য পোস্টসমূহ

  • গ্রে স্কেল চার

    পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় | প্রকাশিত: 24 জুলাই 2025

    সেও এক দিন ছিল!

    ষাটের শেষ, কিংবা সত্তরের শুরু। উঠতি বয়সের সিড়িঙ্গে এক ছোকরা চায়ের দোকানে বিড়ি ফুঁকছে। যেমন ধারালো মুখ তেমন ধারালো জিভ। ফাঁকিবাজ আবার পরোপকারী বলে দুর্নাম। এর বাপকে নালিশ দেবার সাহস কার আছে? মহেশ বাঁড়ুয্যে ডাকসাইটে পণ্ডিত। মামুলি সরকারী চাকুরে হতেই পারেন, কিন্তু খড়ম, সংস্কৃত আর অঙ্কে গায়ত্রী জপেন। তাঁর মেজ ছেলে এমন মারকুটে দুর্মুখ ধারা কোথা থেকে পেলে কেউ জানে না।

  • একশো উত্তম

    পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় | প্রকাশিত: 24 জুলাই 2024

    উঁহু। এ ছবি দেখার মত দৃষ্টিদান আমাকে তো কেউ করে নি। ও আমি কামনাও করিনে। মর্যাদা বলে তো একটা ব্যাপার আছে না কি? ঐ থোবড়া দেখে গোটা বসু পরিবার দিওয়ানা হয়ে গেল, সে কার পাপে বলে দিতে হবে? মুরোদ সাড়ে চুয়াত্তর পয়সার, আর রোয়াব লাখ টাকার। বৌ ঠাকুরাণীর হাটে বেচে দাও না, ঠেলে উঠবে মরণের পারে। যদিও ওরা থাকে ওধারে, তাও তো চাঁপাডাঙার বৌটাকে ঝাড়ি মারে এন্তার। হাবভাব এমন, উনি অন্নপূর্ণার মন্দির বানিয়ে অগ্নিপরীক্ষা দিচ্ছেন যেন।

  • গুরু প্রণাম

    ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য | প্রকাশিত: 30 নভেম্বর 2024

    তেত্রিশ বছর আগের কথা। ক্লাস ফাইভে আমার প্রথম দিন, গরমের ছুটি পড়বে ঠিক তার পরদিন থেকে। নতুন স্কুলেও সেদিনই আমার প্রবেশ, মহারাষ্ট্র থেকে সদ্য এসেছি কলকাতায়, কথায় কথায় হিন্দি মারাঠি 'ঘুসে' যায় তখনও। মা বাবা ভর্তি করে দিলেন স্থানীয় ইশকুলে। রবীন্দ্র বালিকা বিদ্যাপীঠ, বাংলা মাধ্যম, সবুজ স্কার্ট শাদা শার্ট। তবে সেইদিন ছিল রঙ্গিন পোষাকের দিন, গরমের ছুটি পড়ে যাবে এর পর।

  • গ্রে স্কেল দুই

    পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় | প্রকাশিত: 02 নভেম্বর 2024

    সে ছিল আমাদের সোনালি বিকেলের দিনকাল। সিনেমার হিরোরা বুকের মধ্যে তুফান তুলতেন। হিরোইনরা আঁখিয়োসে গোলি মারতেন। পান সিগারেটের দোকানে নিষিদ্ধ সিনেম্যাগের প্রচ্ছদ থেকে মোহিনী দৃষ্টিতে থাকিয়ে থাকতেন রাংতা পোশাকে জুহি, খালি গায়ে সালমান, হৃদয়ভোলানো হাসিতে মাধুরী, ছেঁড়া স্যান্ডো গেঞ্জিতে অক্ষয়। বাজিগরের জন্য তখন স্কুলে অনেকেই দিওয়ানা। এইসব বয়ঃসন্ধির ক্রান্তিকালে অনেকেই একটু আধটু মৌলবাদী হয়ে উঠতাম। আমার থাকবে সালমান মাধুরী, আর কেউ না।

  • ঈদ মোবারক নাসিম

    ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য | প্রকাশিত: 30 মার্চ 2025

    নাসিম, কেমন আছিস?

    আজ ঈদ। ঈদের অকুন্ঠ শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা নিস। আমিও নিলাম। নিয়ে দিয়ে কিছু অতিরিক্ত রয়ে গেলে সেই ভালোবাসায় চল হরির লুট দিই। আমার দিদুন দিতেন তুলসীতলায় দাঁড়িয়ে। তোর নানা সাহেব যেমন যাকাতুল ফিতর দিতেন, রমজানের শেষে।

  • চা

    পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় | প্রকাশিত: 21 মে 2024

    কেটলিতে আধহেমন্তের সকাল বুড়বুড়ি কাটছে। ঐ ঘাড়ে ঘাড়ে জোলো দুধ আর চিনির ডেলা পড়ল। রং দেখ, যেন সাক্ষাৎ মে মাসের দুপুর। সামান্য শিউরে উঠলেন সাঁপুইবাবু। হাতে হাতে পাচার হয়ে যে ভাঁড়টা এসে পৌঁছল তার খোঁদলে উষ্ণ তরলের ওপর পুরু সর। তাও মুখ দেখার ব্যর্থ চেষ্টা তিনি করবেনই। রোজকার মতন। রিফ্লেক্স।

  • কুত্তা বিল্লি ফ্রী

    পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় | প্রকাশিত: 16 আগস্ট 2025

    একটু ইউটোপিয়ার কথা হোক? হ্যাঁ? বেশি না, বছর তিনেক পরে।

    দিল্লি কলকাতা মুম্বাই এখন স্পটলেস ক্লিন। যেদিকে তাকাবেন নো সাইন অফ নেড়ি কুত্তা। কর্পোরেশন সব তুলে সাফ করে দিয়েছে। এখন কুত্তা মানেই বকলস দেওয়া বিলিতি হাইব্রিড। বেশিদিন বাঁচেও না, ইনস্টা স্টোরি ফোরি রিল ফীল হয়ে যাচ্ছে এটাই শান্তি।

  • আহু দারিয়েই

    পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় | প্রকাশিত: 07 নভেম্বর 2024

    আহু দারিয়েই বলে আসলে কিছু নেই।

    বিশ্বাস হচ্ছে না? আপনি বলবেন ভাইরাল হয়েছিলেন আহু দারিয়েই। আপনি বলবেন হিজাব ছাড়া দুই সন্তানের জননী আহু দারিয়েই তেহরানের ইসলামী আজাদ ইউনিভার্সিটিতে পড়তে এসেছিলেন। পর্দা না করার মত গুনাহ ওখানকার মাতব্বরেরা মোটেও কবুল করেননি। তাঁরা এসে তরুণীকে উত্তম মধ্যম দিয়ে তার ঊর্ধ্বাঙ্গের পোষাক কেড়ে তাঁকে ক্ষমা করে ছেড়ে দেন।