দুপুরবেলা পড়তে বসে অংকে ভুল হয়ে যায় মেয়ের, মুঠো খানেকের হৃৎপিন্ডে ছলকে ওঠে রক্ত, বেণীমাধবকে দেখে একদৌড়ে সে পালিয়ে যায় ঘরে। বেণীমাধব, লেখাপড়ায় ভালো, শহুরে, দেখতেও বুঝি রাজপুত্তুরটি।
কিন্তু, মেয়েটির গায়ের রং যে কালো?
কালো মেয়ে, তায় বাপ গরীব, রাজপুত্তুর কি আর তার কপালে জোটে? আচ্ছা, কি এসে যায় রাজপুত্তুর না পেলে? মেয়েজন্মের সার্থকতা কি কেবল ঝকঝকে ঘর, তকতকে বর আর বকবকে বাচ্চা? না, না। তা কখনও হয়! তা তো বলেনি সে! সে বলেছে একটা ছোট্ট কাঁটার কথা। কোথায় যেন বিঁধতেই থাকে। অবিরাম।
আর ঐ কাঁটা তোলার ব্যবসাতেই পাখির চোখ দেখেন ঝোপ বুঝে কোপ মারার কারবারিরা। কোটি কোটি কালো কন্যের দুঃখ ঘোচাতে মঞ্চে নামেন কলির মধুসূদন হিন্দুস্হান লিভার কোম্পানি, হাতে সুদর্শন চক্রের বদলে একখানি নিরীহ ক্রিমভরা টিউব। ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি। বাজারে ঢুকতেই বাজিমাত।
সময়টা 1975। শহর ছেড়ে মফস্বল, মফস্বল ছেড়ে গ্রামে ঢুকতে এক দশকেরও কম সময় লাগে কোম্পানিটির। চোখের পলক ফেলতেই আয়নার তাকে ফিতে, কাজল, টিপের পাশে তো বটেই, ফেয়ার অ্যান্ড লাভলির টিউব হইহই করে ঠাঁই করে নেয় কনের তত্ত্বের ডালাতে, ভাইফোঁটার গিফটে, পকেটমানির বাজেটে। লাফিয়ে লাফিয়ে তার মুনাফা বাড়ে। আজ দু'হাজার কোটির ওপরে তার ব্যবসা। তা বাড়বাড়ন্ত হোক।। আমাদের কি!
মাঝে তারা হেব্বি সমাজ সচেতন ফচেতন হয়ে ব্র্যান্ডের নামও বদলেছিল। ফেয়ার নয় গ্লো। ফর্সা নয়, ফুটফুটে।
এরপর বেনোজলের মতো বাজারে ঢুকে পড়েছে অজস্র রূপটান কোম্পানি, বিউটি ক্লিনিক, মেক-আপ স্টুডিও।এদিকে সোশ্যাল মিডিয়ায় কোরিয়ান সুন্দরীদের আয়নাপিছল ত্বক একেবারে হুড়োহুড়ি ফেলে দিয়েছে বাজারে। ভালো ফোন মানে ভালো ক্যামেরা, এবং তার চাইতেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভালো ফিল্টার - দু এক পোঁচ গাঢ়তা অনায়াসে কমিয়ে দেওয়ার প্রযুক্তির চাহিদা যেন আকাশ ছোঁয়। এমনকি গর্ভজাত সন্তানকে ফর্সা প্যায়দা করার নানান ফিকিরও নাকি চড়াদরে চোরা পথে ঢুকে পড়ছে আজকাল একেবারে ঘরের ভেতরে। পরিসংখ্যান বলছে গত দুই বছরে ফর্সা হওয়ার রূপটানের বাজার বেড়েছে পনোরো শতাংশ বেগে। তার আগের দশ বছরে যার বৃদ্ধির হার ছিল ছয় শতাংশের আশেপাশে। এই মানে সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমির কথাই বলছি।
সেই জন্মভূমি যে কিনা আদর করে মাথায় করে রাখত তার কালো মেয়েদের। দারুণ বিপদে ডাক দিয়েছিল ঘোর কালো একটি মেয়েকে, ইতিহাসের পাতায় যদিও সে লড়াকু মেয়ের নাম নেই, কিন্তু এক বিপুল জনগোষ্ঠীর সামাজিক স্মৃতি থেকে তার খু*নরাঙানো পায়ের ছাপ মোছা যায়নি আজও।
আমরা মন্ত্রতন্ত্র জানিনা, জানতে চাইও না, এমনই আমরা অলম্বুষ। তবু ঐ কালো মেয়েটিকে নিয়ে এক দুই লাইন গান বেঁধে ফেলি, প্রাচীন কোনও উপজাতির নাম না জানা পূজারিণীদের করা কালীপুজোর শোলোক থেকে কথা সুরের প্রসাদ নিয়ে সাহস করে গেয়েও ফেলি, আরও অজস্র কালো মেয়ের কথা বলতে বলতে।
আসুন, সে সব কথা সকলে মিলে বলি। জোরে জোরে বলি। কান ফাটিয়ে বলি।
কেন? আরও যাঁরা এসব কথা বলে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে, তাঁদের ক্রমাগত কন্ঠের দাপটে নতুন প্রজন্ম নাকি সত্যিই ঝেড়ে ফেলতে শুরু করেছে ফর্সা রঙের বদ্ধ সংস্কার। প্রতিফলন পড়ছে বাজারে। ফর্সা হওয়ার পণ্যের বিক্রি গত বছর কমেছে তিন শতাংশ। আরও সাতানব্বই এর রাস্তা বাকি। দেখি কতটা পথ চলা যায়।