কথকতার ছলে জীবনের গল্প বলে মেয়েদের দল Mad Balikas
পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় | প্রকাশিত: 27 ডিসেম্বর 2024

টেলিভিশন জিনিসটা যারা আটের দশকে জন্মেছে তাদের জন্য একটা আস্ত জীবন্ত রূপকথা ছিল। এই কর লো দুনিয়া মুঠ্ঠি মে র অনেক আগের দিনকাল সেসব। আমার গল্পটা বলি, জানি এমন গল্প আছে এ দেশের অনেক প্রৌঢ় পাড়ায় পাড়ায়। তখন সদ্য সদ্য একটা আধটা মধ্যবিত্ত বাড়িতে ঢুকছে সাদা কালো টেলেরামা। রামানন্দ সাগরের ডিরেকশনে দারা সিং নতজানু হয়ে বসে বুক চিরে দেখাচ্ছেন রাম সীতার ছোট্ট পোস্টকার্ড সাইজ ছবি। কেজি নার্সারী ওয়ানের শিশুদের পেন্সিল বক্সে তখন ঐ ছবি একটা দুটো অমনি থাকেই। আর থাকে চরম কৌতূহল। টিভি রাখতে একটা দরজাওয়ালা বাক্স লাগে? ওটাই কি স্টেজ? টিভির লোকগুলো অতক্ষণ নাটক করছে ঐটুকু বাক্সে? বাক্সের পেছনদিকটা বেশী দেখতে গেলে বড়রা ধমক দেয়। কিন্তু লোকগুলোর জলতেষ্টা পায় না? ঐ যে পাহাড়, নদী ওগুলো বাক্সের মধ্যে এল কেমন করে? সবচেয়ে জরুরী কথা হল, ঐ যে মারপিট করে একটা লোক পটল তুলল সেটা কি সত্যি সত্যিই? হতেই পারে না, ঐ তো দুষ্টু লোকটা আরেকটা সিনেমায় এসেছে। এত প্রশ্নের উত্তর কেউ দেবে না, তাছাড়া কিছু প্রশ্ন থাকেই যা জিজ্ঞেস করতে নেই। তার চেয়ে অবরে সবরে ঐ গাইতে গাইতে নাচাটা কায়দা করতেই পারলে জীবন ফতে। শুধু কি নাচ-গান? প্লাস্টিকের গদা পায়নি এমন শিশু তখন ভূভারতে ছিল না। গদা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খুব যুদ্ধু যুদ্ধু খেলা হত। আর সাধ হত ক্ষয়ে আসা মোম রঙে তেকোনা পাহাড়, আধখানা সূর্য, খড়ের চালওলা কুঁড়েঘর আঁকার পর একটা টেলিভিশন এঁকে রাখার। কত সুবিধে বাড়িতে টিভি থাকলে। দৌড়োদৌড়ি করে অন্যলোকের বাড়ী যাবার পার্মিশন চাইতে হয় না। রামায়ণের সঙ্গে হি-ম্যানটাও চাইলেই দেখা যায়। কালার টিভি জিনিসটা ঠিক কী? কতটা বড়লোক হলে কালার টিভি রাখা যায়?

আমার নিম্নবিত্ত প্রাইভেট অঙ্ক টিউটর বাবা কী বুঝেছিলেন জানি না, অসম্ভব কম উপার্জনের টাকায় নিয়ে এসেছিলেন দরজাওলা ক্যাবিনেট সহ একটা আস্ত টেলেরামা টিভি। কী আনন্দ! একচিলতে ঘরে লোক ভেঙে পড়ে দেখতে এল। বাপ রে, অঙ্ক করিয়ে কত টাকা পায়? সেসব হিংসুটে ফিসফাস বোঝার মত বোধ বুদ্ধি বয়স তেমন ছিল না, তবে শিঙিমাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে উঠে গেলে প্রায়দিনই দেখতুম হাড্ডিসার মা আর রাশভারী বাবা আলু পেঁয়াজের তরকারি দিয়ে ভাত খাওয়া সারছেন। কেজি ওয়ানের মাথায় তখন একটাই চিন্তা, রোববারে হি-ম্যান দেখতে দেবে? না দেবে না?

শর্তাধীন টিভি দেখার সেই শুরু। মালিকপক্ষের ফরমান, সকালে উঠে অঙ্ক সারলে তবেই টেলিভিশন। তাও ঘন্টা মেপে। শ্রমিকপক্ষ একদিন ওয়াচ আওয়ার বাড়ানোর দাবি পেশ করল, দাবি না-মঞ্জুর হল। বেআইনী দাবির শাস্তি হিসেবে এল ইংরাজি হাতের লেখা। বেয়াড়া শ্রমিক সেদিন তার বিখ্যাত মুক্তোমাফিক হাতের লেখা ছুঁড়ে ফেলে ট্যারাব্যাঁকা অক্ষরে ক্ষোভ উজাড় করে দিল। তারপর? হাড্ডিসার মা দশ বালতি জল তুলে হাঁপাতে হাঁপাতে খাতা দেখতে এসে আঁতকে উঠলেন। লেখাপড়ার ওপর এত অবহেলা? তারপরে বিখ্যাত সেই ডায়লগ - "আসুক তোর বাবা!"

পুলিশের ধোলাইয়ের পর বিচারক এলেন। হাতের লেখা দেখে রুলটানা পাতা একটানে ছিঁড়ে দশটুকরো করলেন। তারপর পুলিশকে বললেন আসামী ঐ লেখাই আবার লিখবে। সেটাও খারাপ হলে দশটুকরো। আবার চলবে। আপাতত নাওয়া খাওয়া বন্ধ। টিভি বন্ধ। তার ভবিষ্যত খানিক অনিশ্চিত।

বেগতিক দেখে আসামী আমি জীবনের সেরা হাতের লেখাটা লিখতে পেরেছিলাম কিনা এখন আর মনে নেই। এখন লেখাই তো হয় না, সব টাইপ করা। সেই টেলেরামা টিভিটা কবে বিদায় নিয়েছে সেইসব টকঝালমিষ্টি দিনগুলোর মতন, কেউ খেয়ালও করেনি। এখন গ্রে স্কেল বলে চোখ বুজলেই দেখতে পাই ছিয়াশি পল্লীর বস্তির সেই বাড়িটাতে একটা ছোট্ট ভাড়া ঘরে এক বালিকা ধরে ধরে হাতের লেখা করছে। সামনে বন্ধ টিভি। যেদিন প্রমাণ হবে লেখাপড়ায় অবহেলা করা হয়নি, সেদিন টিভি চলবে। টিনের চালে বৃষ্টি পড়ে হাসে, বলে দিন কি শুধু তোর বাপের?

আপনার মতামত

এর উত্তরে Some User

এই বিভাগের অন্যান্য পোস্টসমূহ

  • একশো উত্তম

    পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় | প্রকাশিত: 24 জুলাই 2024

    উঁহু। এ ছবি দেখার মত দৃষ্টিদান আমাকে তো কেউ করে নি। ও আমি কামনাও করিনে। মর্যাদা বলে তো একটা ব্যাপার আছে না কি? ঐ থোবড়া দেখে গোটা বসু পরিবার দিওয়ানা হয়ে গেল, সে কার পাপে বলে দিতে হবে? মুরোদ সাড়ে চুয়াত্তর পয়সার, আর রোয়াব লাখ টাকার। বৌ ঠাকুরাণীর হাটে বেচে দাও না, ঠেলে উঠবে মরণের পারে। যদিও ওরা থাকে ওধারে, তাও তো চাঁপাডাঙার বৌটাকে ঝাড়ি মারে এন্তার। হাবভাব এমন, উনি অন্নপূর্ণার মন্দির বানিয়ে অগ্নিপরীক্ষা দিচ্ছেন যেন।

  • গুরু প্রণাম

    ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য | প্রকাশিত: 30 নভেম্বর 2024

    তেত্রিশ বছর আগের কথা। ক্লাস ফাইভে আমার প্রথম দিন, গরমের ছুটি পড়বে ঠিক তার পরদিন থেকে। নতুন স্কুলেও সেদিনই আমার প্রবেশ, মহারাষ্ট্র থেকে সদ্য এসেছি কলকাতায়, কথায় কথায় হিন্দি মারাঠি 'ঘুসে' যায় তখনও। মা বাবা ভর্তি করে দিলেন স্থানীয় ইশকুলে। রবীন্দ্র বালিকা বিদ্যাপীঠ, বাংলা মাধ্যম, সবুজ স্কার্ট শাদা শার্ট। তবে সেইদিন ছিল রঙ্গিন পোষাকের দিন, গরমের ছুটি পড়ে যাবে এর পর।

  • আহু দারিয়েই

    পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় | প্রকাশিত: 07 নভেম্বর 2024

    আহু দারিয়েই বলে আসলে কিছু নেই।

    বিশ্বাস হচ্ছে না? আপনি বলবেন ভাইরাল হয়েছিলেন আহু দারিয়েই। আপনি বলবেন হিজাব ছাড়া দুই সন্তানের জননী আহু দারিয়েই তেহরানের ইসলামী আজাদ ইউনিভার্সিটিতে পড়তে এসেছিলেন। পর্দা না করার মত গুনাহ ওখানকার মাতব্বরেরা মোটেও কবুল করেননি। তাঁরা এসে তরুণীকে উত্তম মধ্যম দিয়ে তার ঊর্ধ্বাঙ্গের পোষাক কেড়ে তাঁকে ক্ষমা করে ছেড়ে দেন।

  • কালো মেয়ে

    ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য | প্রকাশিত: 25 অক্টোবার 2024

    দুপুরবেলা পড়তে বসে অংকে ভুল হয়ে যায় মেয়ের, মুঠো খানেকের হৃৎপিন্ডে ছলকে ওঠে রক্ত, বেণীমাধবকে দেখে একদৌড়ে সে পালিয়ে যায় ঘরে। বেণীমাধব, লেখাপড়ায় ভালো, শহুরে, দেখতেও বুঝি রাজপুত্তুরটি।

    কিন্তু, মেয়েটির গায়ের রং যে কালো?

  • চা

    পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় | প্রকাশিত: 21 মে 2024

    কেটলিতে আধহেমন্তের সকাল বুড়বুড়ি কাটছে। ঐ ঘাড়ে ঘাড়ে জোলো দুধ আর চিনির ডেলা পড়ল। রং দেখ, যেন সাক্ষাৎ মে মাসের দুপুর। সামান্য শিউরে উঠলেন সাঁপুইবাবু। হাতে হাতে পাচার হয়ে যে ভাঁড়টা এসে পৌঁছল তার খোঁদলে উষ্ণ তরলের ওপর পুরু সর। তাও মুখ দেখার ব্যর্থ চেষ্টা তিনি করবেনই। রোজকার মতন। রিফ্লেক্স।

  • গ্রে স্কেল চার

    পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় | প্রকাশিত: 24 জুলাই 2025

    সেও এক দিন ছিল!

    ষাটের শেষ, কিংবা সত্তরের শুরু। উঠতি বয়সের সিড়িঙ্গে এক ছোকরা চায়ের দোকানে বিড়ি ফুঁকছে। যেমন ধারালো মুখ তেমন ধারালো জিভ। ফাঁকিবাজ আবার পরোপকারী বলে দুর্নাম। এর বাপকে নালিশ দেবার সাহস কার আছে? মহেশ বাঁড়ুয্যে ডাকসাইটে পণ্ডিত। মামুলি সরকারী চাকুরে হতেই পারেন, কিন্তু খড়ম, সংস্কৃত আর অঙ্কে গায়ত্রী জপেন। তাঁর মেজ ছেলে এমন মারকুটে দুর্মুখ ধারা কোথা থেকে পেলে কেউ জানে না।

  • কুত্তা বিল্লি ফ্রী

    পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় | প্রকাশিত: 16 আগস্ট 2025

    একটু ইউটোপিয়ার কথা হোক? হ্যাঁ? বেশি না, বছর তিনেক পরে।

    দিল্লি কলকাতা মুম্বাই এখন স্পটলেস ক্লিন। যেদিকে তাকাবেন নো সাইন অফ নেড়ি কুত্তা। কর্পোরেশন সব তুলে সাফ করে দিয়েছে। এখন কুত্তা মানেই বকলস দেওয়া বিলিতি হাইব্রিড। বেশিদিন বাঁচেও না, ইনস্টা স্টোরি ফোরি রিল ফীল হয়ে যাচ্ছে এটাই শান্তি।

  • গ্রে স্কেল দুই

    পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় | প্রকাশিত: 02 নভেম্বর 2024

    সে ছিল আমাদের সোনালি বিকেলের দিনকাল। সিনেমার হিরোরা বুকের মধ্যে তুফান তুলতেন। হিরোইনরা আঁখিয়োসে গোলি মারতেন। পান সিগারেটের দোকানে নিষিদ্ধ সিনেম্যাগের প্রচ্ছদ থেকে মোহিনী দৃষ্টিতে থাকিয়ে থাকতেন রাংতা পোশাকে জুহি, খালি গায়ে সালমান, হৃদয়ভোলানো হাসিতে মাধুরী, ছেঁড়া স্যান্ডো গেঞ্জিতে অক্ষয়। বাজিগরের জন্য তখন স্কুলে অনেকেই দিওয়ানা। এইসব বয়ঃসন্ধির ক্রান্তিকালে অনেকেই একটু আধটু মৌলবাদী হয়ে উঠতাম। আমার থাকবে সালমান মাধুরী, আর কেউ না।