টেলিভিশন জিনিসটা যারা আটের দশকে জন্মেছে তাদের জন্য একটা আস্ত জীবন্ত রূপকথা ছিল। এই কর লো দুনিয়া মুঠ্ঠি মে র অনেক আগের দিনকাল সেসব। আমার গল্পটা বলি, জানি এমন গল্প আছে এ দেশের অনেক প্রৌঢ় পাড়ায় পাড়ায়। তখন সদ্য সদ্য একটা আধটা মধ্যবিত্ত বাড়িতে ঢুকছে সাদা কালো টেলেরামা। রামানন্দ সাগরের ডিরেকশনে দারা সিং নতজানু হয়ে বসে বুক চিরে দেখাচ্ছেন রাম সীতার ছোট্ট পোস্টকার্ড সাইজ ছবি। কেজি নার্সারী ওয়ানের শিশুদের পেন্সিল বক্সে তখন ঐ ছবি একটা দুটো অমনি থাকেই। আর থাকে চরম কৌতূহল। টিভি রাখতে একটা দরজাওয়ালা বাক্স লাগে? ওটাই কি স্টেজ? টিভির লোকগুলো অতক্ষণ নাটক করছে ঐটুকু বাক্সে? বাক্সের পেছনদিকটা বেশী দেখতে গেলে বড়রা ধমক দেয়। কিন্তু লোকগুলোর জলতেষ্টা পায় না? ঐ যে পাহাড়, নদী ওগুলো বাক্সের মধ্যে এল কেমন করে? সবচেয়ে জরুরী কথা হল, ঐ যে মারপিট করে একটা লোক পটল তুলল সেটা কি সত্যি সত্যিই? হতেই পারে না, ঐ তো দুষ্টু লোকটা আরেকটা সিনেমায় এসেছে। এত প্রশ্নের উত্তর কেউ দেবে না, তাছাড়া কিছু প্রশ্ন থাকেই যা জিজ্ঞেস করতে নেই। তার চেয়ে অবরে সবরে ঐ গাইতে গাইতে নাচাটা কায়দা করতেই পারলে জীবন ফতে। শুধু কি নাচ-গান? প্লাস্টিকের গদা পায়নি এমন শিশু তখন ভূভারতে ছিল না। গদা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খুব যুদ্ধু যুদ্ধু খেলা হত। আর সাধ হত ক্ষয়ে আসা মোম রঙে তেকোনা পাহাড়, আধখানা সূর্য, খড়ের চালওলা কুঁড়েঘর আঁকার পর একটা টেলিভিশন এঁকে রাখার। কত সুবিধে বাড়িতে টিভি থাকলে। দৌড়োদৌড়ি করে অন্যলোকের বাড়ী যাবার পার্মিশন চাইতে হয় না। রামায়ণের সঙ্গে হি-ম্যানটাও চাইলেই দেখা যায়। কালার টিভি জিনিসটা ঠিক কী? কতটা বড়লোক হলে কালার টিভি রাখা যায়?
আমার নিম্নবিত্ত প্রাইভেট অঙ্ক টিউটর বাবা কী বুঝেছিলেন জানি না, অসম্ভব কম উপার্জনের টাকায় নিয়ে এসেছিলেন দরজাওলা ক্যাবিনেট সহ একটা আস্ত টেলেরামা টিভি। কী আনন্দ! একচিলতে ঘরে লোক ভেঙে পড়ে দেখতে এল। বাপ রে, অঙ্ক করিয়ে কত টাকা পায়? সেসব হিংসুটে ফিসফাস বোঝার মত বোধ বুদ্ধি বয়স তেমন ছিল না, তবে শিঙিমাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে উঠে গেলে প্রায়দিনই দেখতুম হাড্ডিসার মা আর রাশভারী বাবা আলু পেঁয়াজের তরকারি দিয়ে ভাত খাওয়া সারছেন। কেজি ওয়ানের মাথায় তখন একটাই চিন্তা, রোববারে হি-ম্যান দেখতে দেবে? না দেবে না?
শর্তাধীন টিভি দেখার সেই শুরু। মালিকপক্ষের ফরমান, সকালে উঠে অঙ্ক সারলে তবেই টেলিভিশন। তাও ঘন্টা মেপে। শ্রমিকপক্ষ একদিন ওয়াচ আওয়ার বাড়ানোর দাবি পেশ করল, দাবি না-মঞ্জুর হল। বেআইনী দাবির শাস্তি হিসেবে এল ইংরাজি হাতের লেখা। বেয়াড়া শ্রমিক সেদিন তার বিখ্যাত মুক্তোমাফিক হাতের লেখা ছুঁড়ে ফেলে ট্যারাব্যাঁকা অক্ষরে ক্ষোভ উজাড় করে দিল। তারপর? হাড্ডিসার মা দশ বালতি জল তুলে হাঁপাতে হাঁপাতে খাতা দেখতে এসে আঁতকে উঠলেন। লেখাপড়ার ওপর এত অবহেলা? তারপরে বিখ্যাত সেই ডায়লগ - "আসুক তোর বাবা!"
পুলিশের ধোলাইয়ের পর বিচারক এলেন। হাতের লেখা দেখে রুলটানা পাতা একটানে ছিঁড়ে দশটুকরো করলেন। তারপর পুলিশকে বললেন আসামী ঐ লেখাই আবার লিখবে। সেটাও খারাপ হলে দশটুকরো। আবার চলবে। আপাতত নাওয়া খাওয়া বন্ধ। টিভি বন্ধ। তার ভবিষ্যত খানিক অনিশ্চিত।
বেগতিক দেখে আসামী আমি জীবনের সেরা হাতের লেখাটা লিখতে পেরেছিলাম কিনা এখন আর মনে নেই। এখন লেখাই তো হয় না, সব টাইপ করা। সেই টেলেরামা টিভিটা কবে বিদায় নিয়েছে সেইসব টকঝালমিষ্টি দিনগুলোর মতন, কেউ খেয়ালও করেনি। এখন গ্রে স্কেল বলে চোখ বুজলেই দেখতে পাই ছিয়াশি পল্লীর বস্তির সেই বাড়িটাতে একটা ছোট্ট ভাড়া ঘরে এক বালিকা ধরে ধরে হাতের লেখা করছে। সামনে বন্ধ টিভি। যেদিন প্রমাণ হবে লেখাপড়ায় অবহেলা করা হয়নি, সেদিন টিভি চলবে। টিনের চালে বৃষ্টি পড়ে হাসে, বলে দিন কি শুধু তোর বাপের?