কথকতার ছলে জীবনের গল্প বলে মেয়েদের দল Mad Balikas
পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় | প্রকাশিত: 24 জুলাই 2025

সেও এক দিন ছিল!

ষাটের শেষ, কিংবা সত্তরের শুরু। উঠতি বয়সের সিড়িঙ্গে এক ছোকরা চায়ের দোকানে বিড়ি ফুঁকছে। যেমন ধারালো মুখ তেমন ধারালো জিভ। ফাঁকিবাজ আবার পরোপকারী বলে দুর্নাম। এর বাপকে নালিশ দেবার সাহস কার আছে? মহেশ বাঁড়ুয্যে ডাকসাইটে পণ্ডিত। মামুলি সরকারী চাকুরে হতেই পারেন, কিন্তু খড়ম, সংস্কৃত আর অঙ্কে গায়ত্রী জপেন। তাঁর মেজ ছেলে এমন মারকুটে দুর্মুখ ধারা কোথা থেকে পেলে কেউ জানে না। হ্যাঁ, ছোকরার মা-দিদিমা কিঞ্চিত অ্যাকশন ঘরানার, আগে হাতের সুখ করে তারপরে বৃত্তান্ত দেখেন, তাই বলে এ ছোকরা হায়ার সেকেন্ডারি উতরানোর আগেই কলেজ পড়ুয়া দাদাদের মুখের ওপর মোহনবাগানের হারজিত প্রেডিকশন আগাম সপাট ছুঁড়ে দেবে তেমনধারা সিদ্ধপুরুষ ডিএনএ বাগানোর রহস্যটা কেউ আঁচ করতে পারে নি। অবশ্যই সেটা জরুরী নয়। শিল্ড ঘরে আসবে কিনা তাই নিয়ে হিসেব নিকেশ এখনও শুরু হয়নি। গুরুতর কথা হচ্ছে, গুরুর নতুন সিনেমা। অ্যান্টনী ফিরিঙ্গির ঘটনাটা ফিরিঙ্গি কালীবাড়ির সঙ্গে কতটা জড়িয়ে তাই নিয়ে তুমুল তর্ক উঠেছিল। আপাতত তার দিক ঘুরে গেছে উল্টোরথের প্রচ্ছদে। আর বলাই বাহুল্য সব তর্ক ঘুরপাক খাচ্ছে সেই দুর্মুখ সবজান্তা ছোঁড়াকে সেন্টারে রেখে।

“গুরু যখন করেছে, ফাটিয়ে দিয়েছে। বম্বের হিরোইনটা কিন্তু বেশ চেনা লাগল।”

“জুয়েল থিফে ছিল না মেয়েটা? তনুজা তো?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ। ঐ মেয়েটাই। গুরুর পাশে বম্বের হিরোইন কেমন একটা লাগছে না? বেণু তুই জুয়েল থিফটা মিস করিস না, দেবানন্দ দেখিয়ে দিয়েছে হিরো কাকে বলে।”

“আরে রাখ তোর দেবানন্দ। দিলীপ কুমার ডবল রোলটা কি করেছে ভাই, সেটা ভুললে হবে? রাম আউর শ্যাম একটা করে দেখাক তোর জুয়েল থিফ। বেণু, বল? ঠিক বলিনি?”

“আমাদের গুরুও বম্বে গেলে পারত। ডবল রোল পেত, ডবল হিরোইন পেত”

“গুরুর হিরোইন লাগে না ভাই। আমি যামিনী তুমি শশী হে তে লিপটা দিয়েছে দেখলি? এই বেণু, বল না?”

বেণু, অর্থাৎ সেই দুর্মুখ সবজান্তা ছোকরা ভুরু কুঁচকে খবরের কাগজ দেখছিল। একদম ভেতরের পাতা, চেয়েচিন্তে পাওয়া। অন্যমনস্ক ভাবে বলল - “হুঁ”

উত্তেজিত তরজাটা খানিক হতাশ হল। কেউ একজন বলে উঠল

“বেণু তোর পরীক্ষা শেষ কবে হবে রে? চল, বম্বে ঘুরে আসি একবার। তোর বড়মামা আছে না ওখানে? চল যাই, কাকাকে একবার দেখতে পাই যদি!”

নিরুত্তর বেণুর আগেই তড়বড় করে উঠল আরেকজন।

“বেণুর মামাবাড়ি বম্বেতে তো তোর কাকার কি রে শালা!

“আরে এ কাকা আমাদের কাকা, রাজেশ খান্নার কথা বলছি!”

“ও গেলে ওর মামার কাছে যাবে, রাজেশ খান্না ওর মামা নাকি? অত সোজা? তাহলে তো এরোপ্লেনও পাখি রে! এই বেণু, কী অত পড়ছিস? চালের দাম আবার বাড়ছে নাকি?”

“আরে বেণু পরীক্ষার পড়া করছে মনে হয়”

“ওসব পরীক্ষা টরীক্ষা সব ঢপ। বাপ বলেছে এই শেষ, আর পড়ার খরচ দেবে না। কুলোতে পারছে না। একটা চাকরি কোথায় পাই বল তো?”

“এই পেনে যতক্ষণ কালি থাকবে ততক্ষণ আজ চাকরির দরখাস্ত লিখব। আজ আমি সারাদিন নড়ছি না। এই একটা কাউন্টার দেব, এদিকে বিড়িটা দে তো।”

গজল্লার মধ্যে একমাত্র নীরব পাঠক বেণু খবরের কাগজটা ছুঁড়ে ফেলল। রমাদাটা বড্ড ভালো পড়াত। হরলিক্সের শিশির মত মোটা কাঁচের চশমা, সাংঘাতিক পাওয়ার। কমিউনিজমটা ভালো বুঝত, বোঝাত একঘর। গতমাসের পরে আর পড়াতে আসেনি। মাইনেও নেয়নি। আর আসবেও না। আসতে পারলে তো আর খবর হত না। আসবে না বলেই রমাপতি সান্যাল আজ খবরের কাগজের পাঁচের পাতায় চার লাইনে খবর হয়েছে। দুষ্কৃতি সন্দেহে পুলিশের গুলি! দূর, রমাদাটা মরে গেল?

গজল্লাটা এতক্ষণে হিন্দি বাংলা খিস্তির তুলনামূলক গবেষণায় ঘুরছিল, হঠাৎই একটা বাজখাঁই চিৎকারে হোঁচট খেল।

“অ্যাই প্রণব, অ্যাই প্রণব। প্রণব! চায়ের দোকানে ফস্টিনস্টি হচ্ছে? আজকের দিনে এখন এখানে বসে আড্ডা হচ্ছে হতভাগা!”

গজল্লা এতক্ষণ যতই যাই গবেষণা করুক, তীর্থপতির অঙ্কের রাশভারী স্যার এসে তাতে যোগ দেবেন সে কেমন কথা! গবেষকরা এদিকে ওদিকে ছিটকে গেল। মধ্যমণি বেণু চট করে হাতের সিগারেটটা ফেলে চপ্পল দিয়ে নিভিয়ে দিল। স্টীম ইঞ্জিনের মত স্যার সামনে এসে দাঁত খিঁচোলেন।

“হতভাগা ছেলে! আজ যে অঙ্ক পরীক্ষা সে খেয়াল আছে? না কি লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে এই কুলাঙ্গার গুলোর সঙ্গে দিন কাটাবে ঠিক করেছ?”

প্রণব, থুড়ি বেণু সচরাচর চমকায় না। একটু ত্যাড়াভাব বজায় রাখা কর্তব্যবোধে বলল

“আজ নয়, পরীক্ষা তো পরশু।”

বলাই বাহুল্য জীবনের প্রতিটাদিনই অগ্নিপরীক্ষা। কিন্তু স্যার এহেন দর্শনে বিশেষ আস্থা রাখেন না দেখা গেল। পরশুদিন পরীক্ষার প্রস্তাবটাকে হাত নেড়ে মাছির মত উড়িয়ে বললেন,

“বাঁদর ছেলে, পরীক্ষার দিন চেঞ্জ হয়েছে সেটা কি বাড়ি গিয়ে বলে আসতে হবে তোমায়? বলি এ বছর হায়ার সেকেন্ডারি পাশ দেবার ইচ্ছে টিচ্ছে আছে না নেই? আর আধঘন্টা পরে গেট বন্ধ হয়ে যাবে। আমার তো আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই, তোমার মত জ্যাঠা ছেলেদের-”

স্যারের প্রশংসা শেষ হবার আগেই বেণু চিলের মত ছোঁ মেরে দরখাস্তকারীর চাকরির পেনটা হাতিয়ে বলল,

“যাচ্ছি স্যার, এক্ষুণি যাচ্ছি।”



গজল্লাটা হাঁ করে দেখল ছোকরা খোলা ডটপেন হাতে ছুটছে হায়ার সেকেন্ডারির অঙ্ক পরীক্ষা দিতে। রাশভারী স্যার গজগজ করতে করতে স্কুলের দিকে হাঁটা লাগাচ্ছেন।

এই গজল্লাটা দেখতে পায়নি ছোকরার দৌড়টা কত লম্বা ছিল। সব পরীক্ষায় কি আর লেটার আসে! সেবার অবশ্য লেটার হয়েছিল। পরে সে ছোকরা নিজেই অন্য ছেলেমেয়েদের অঙ্কে লেটার পাওয়ানোতে মন দিয়েছিল।

এই গল্প হতেই পারে মনগড়া। এই গল্প যার সে নিজেই চলে গেছে আজ বারো বছর। এক যুগ! সে নিজেই এইসব ছাইপাঁশ লেখা দেখলে মুচকি হাসত নিশ্চিত। তবে তাই বলে কি আর গল্প সত্যি হয় না? আজও যখন যেখানে কোনও কিশোর ঘাড় বেঁকিয়ে তর্ক জোড়ে, ঠোঁটকাটা জবাব দেয়, আপোষ করতে বললে পাপোশ করে দেয়, আমি যেন তাকেই দেখি। সেই শোনা গল্পের চেনা কিশোর।

বেণু, আমার বাবা।

আপনার মতামত

এর উত্তরে Some User

এই বিভাগের অন্যান্য পোস্টসমূহ

  • ঈদ মোবারক নাসিম

    ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য | প্রকাশিত: 30 মার্চ 2025

    নাসিম, কেমন আছিস?

    আজ ঈদ। ঈদের অকুন্ঠ শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা নিস। আমিও নিলাম। নিয়ে দিয়ে কিছু অতিরিক্ত রয়ে গেলে সেই ভালোবাসায় চল হরির লুট দিই। আমার দিদুন দিতেন তুলসীতলায় দাঁড়িয়ে। তোর নানা সাহেব যেমন যাকাতুল ফিতর দিতেন, রমজানের শেষে।

  • কালো মেয়ে

    ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য | প্রকাশিত: 25 অক্টোবার 2024

    দুপুরবেলা পড়তে বসে অংকে ভুল হয়ে যায় মেয়ের, মুঠো খানেকের হৃৎপিন্ডে ছলকে ওঠে রক্ত, বেণীমাধবকে দেখে একদৌড়ে সে পালিয়ে যায় ঘরে। বেণীমাধব, লেখাপড়ায় ভালো, শহুরে, দেখতেও বুঝি রাজপুত্তুরটি।

    কিন্তু, মেয়েটির গায়ের রং যে কালো?

  • আহু দারিয়েই

    পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় | প্রকাশিত: 07 নভেম্বর 2024

    আহু দারিয়েই বলে আসলে কিছু নেই।

    বিশ্বাস হচ্ছে না? আপনি বলবেন ভাইরাল হয়েছিলেন আহু দারিয়েই। আপনি বলবেন হিজাব ছাড়া দুই সন্তানের জননী আহু দারিয়েই তেহরানের ইসলামী আজাদ ইউনিভার্সিটিতে পড়তে এসেছিলেন। পর্দা না করার মত গুনাহ ওখানকার মাতব্বরেরা মোটেও কবুল করেননি। তাঁরা এসে তরুণীকে উত্তম মধ্যম দিয়ে তার ঊর্ধ্বাঙ্গের পোষাক কেড়ে তাঁকে ক্ষমা করে ছেড়ে দেন।

  • গ্রে স্কেল দুই

    পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় | প্রকাশিত: 02 নভেম্বর 2024

    সে ছিল আমাদের সোনালি বিকেলের দিনকাল। সিনেমার হিরোরা বুকের মধ্যে তুফান তুলতেন। হিরোইনরা আঁখিয়োসে গোলি মারতেন। পান সিগারেটের দোকানে নিষিদ্ধ সিনেম্যাগের প্রচ্ছদ থেকে মোহিনী দৃষ্টিতে থাকিয়ে থাকতেন রাংতা পোশাকে জুহি, খালি গায়ে সালমান, হৃদয়ভোলানো হাসিতে মাধুরী, ছেঁড়া স্যান্ডো গেঞ্জিতে অক্ষয়। বাজিগরের জন্য তখন স্কুলে অনেকেই দিওয়ানা। এইসব বয়ঃসন্ধির ক্রান্তিকালে অনেকেই একটু আধটু মৌলবাদী হয়ে উঠতাম। আমার থাকবে সালমান মাধুরী, আর কেউ না।

  • গুরু প্রণাম

    ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য | প্রকাশিত: 30 নভেম্বর 2024

    তেত্রিশ বছর আগের কথা। ক্লাস ফাইভে আমার প্রথম দিন, গরমের ছুটি পড়বে ঠিক তার পরদিন থেকে। নতুন স্কুলেও সেদিনই আমার প্রবেশ, মহারাষ্ট্র থেকে সদ্য এসেছি কলকাতায়, কথায় কথায় হিন্দি মারাঠি 'ঘুসে' যায় তখনও। মা বাবা ভর্তি করে দিলেন স্থানীয় ইশকুলে। রবীন্দ্র বালিকা বিদ্যাপীঠ, বাংলা মাধ্যম, সবুজ স্কার্ট শাদা শার্ট। তবে সেইদিন ছিল রঙ্গিন পোষাকের দিন, গরমের ছুটি পড়ে যাবে এর পর।

  • একশো উত্তম

    পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় | প্রকাশিত: 24 জুলাই 2024

    উঁহু। এ ছবি দেখার মত দৃষ্টিদান আমাকে তো কেউ করে নি। ও আমি কামনাও করিনে। মর্যাদা বলে তো একটা ব্যাপার আছে না কি? ঐ থোবড়া দেখে গোটা বসু পরিবার দিওয়ানা হয়ে গেল, সে কার পাপে বলে দিতে হবে? মুরোদ সাড়ে চুয়াত্তর পয়সার, আর রোয়াব লাখ টাকার। বৌ ঠাকুরাণীর হাটে বেচে দাও না, ঠেলে উঠবে মরণের পারে। যদিও ওরা থাকে ওধারে, তাও তো চাঁপাডাঙার বৌটাকে ঝাড়ি মারে এন্তার। হাবভাব এমন, উনি অন্নপূর্ণার মন্দির বানিয়ে অগ্নিপরীক্ষা দিচ্ছেন যেন।

  • চা

    পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় | প্রকাশিত: 21 মে 2024

    কেটলিতে আধহেমন্তের সকাল বুড়বুড়ি কাটছে। ঐ ঘাড়ে ঘাড়ে জোলো দুধ আর চিনির ডেলা পড়ল। রং দেখ, যেন সাক্ষাৎ মে মাসের দুপুর। সামান্য শিউরে উঠলেন সাঁপুইবাবু। হাতে হাতে পাচার হয়ে যে ভাঁড়টা এসে পৌঁছল তার খোঁদলে উষ্ণ তরলের ওপর পুরু সর। তাও মুখ দেখার ব্যর্থ চেষ্টা তিনি করবেনই। রোজকার মতন। রিফ্লেক্স।

  • কুত্তা বিল্লি ফ্রী

    পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় | প্রকাশিত: 16 আগস্ট 2025

    একটু ইউটোপিয়ার কথা হোক? হ্যাঁ? বেশি না, বছর তিনেক পরে।

    দিল্লি কলকাতা মুম্বাই এখন স্পটলেস ক্লিন। যেদিকে তাকাবেন নো সাইন অফ নেড়ি কুত্তা। কর্পোরেশন সব তুলে সাফ করে দিয়েছে। এখন কুত্তা মানেই বকলস দেওয়া বিলিতি হাইব্রিড। বেশিদিন বাঁচেও না, ইনস্টা স্টোরি ফোরি রিল ফীল হয়ে যাচ্ছে এটাই শান্তি।