সেও এক দিন ছিল!
ষাটের শেষ, কিংবা সত্তরের শুরু। উঠতি বয়সের সিড়িঙ্গে এক ছোকরা চায়ের দোকানে বিড়ি ফুঁকছে। যেমন ধারালো মুখ তেমন ধারালো জিভ। ফাঁকিবাজ আবার পরোপকারী বলে দুর্নাম। এর বাপকে নালিশ দেবার সাহস কার আছে? মহেশ বাঁড়ুয্যে ডাকসাইটে পণ্ডিত। মামুলি সরকারী চাকুরে হতেই পারেন, কিন্তু খড়ম, সংস্কৃত আর অঙ্কে গায়ত্রী জপেন। তাঁর মেজ ছেলে এমন মারকুটে দুর্মুখ ধারা কোথা থেকে পেলে কেউ জানে না। হ্যাঁ, ছোকরার মা-দিদিমা কিঞ্চিত অ্যাকশন ঘরানার, আগে হাতের সুখ করে তারপরে বৃত্তান্ত দেখেন, তাই বলে এ ছোকরা হায়ার সেকেন্ডারি উতরানোর আগেই কলেজ পড়ুয়া দাদাদের মুখের ওপর মোহনবাগানের হারজিত প্রেডিকশন আগাম সপাট ছুঁড়ে দেবে তেমনধারা সিদ্ধপুরুষ ডিএনএ বাগানোর রহস্যটা কেউ আঁচ করতে পারে নি। অবশ্যই সেটা জরুরী নয়। শিল্ড ঘরে আসবে কিনা তাই নিয়ে হিসেব নিকেশ এখনও শুরু হয়নি। গুরুতর কথা হচ্ছে, গুরুর নতুন সিনেমা। অ্যান্টনী ফিরিঙ্গির ঘটনাটা ফিরিঙ্গি কালীবাড়ির সঙ্গে কতটা জড়িয়ে তাই নিয়ে তুমুল তর্ক উঠেছিল। আপাতত তার দিক ঘুরে গেছে উল্টোরথের প্রচ্ছদে। আর বলাই বাহুল্য সব তর্ক ঘুরপাক খাচ্ছে সেই দুর্মুখ সবজান্তা ছোঁড়াকে সেন্টারে রেখে।
“গুরু যখন করেছে, ফাটিয়ে দিয়েছে। বম্বের হিরোইনটা কিন্তু বেশ চেনা লাগল।”
“জুয়েল থিফে ছিল না মেয়েটা? তনুজা তো?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ। ঐ মেয়েটাই। গুরুর পাশে বম্বের হিরোইন কেমন একটা লাগছে না? বেণু তুই জুয়েল থিফটা মিস করিস না, দেবানন্দ দেখিয়ে দিয়েছে হিরো কাকে বলে।”
“আরে রাখ তোর দেবানন্দ। দিলীপ কুমার ডবল রোলটা কি করেছে ভাই, সেটা ভুললে হবে? রাম আউর শ্যাম একটা করে দেখাক তোর জুয়েল থিফ। বেণু, বল? ঠিক বলিনি?”
“আমাদের গুরুও বম্বে গেলে পারত। ডবল রোল পেত, ডবল হিরোইন পেত”
“গুরুর হিরোইন লাগে না ভাই। আমি যামিনী তুমি শশী হে তে লিপটা দিয়েছে দেখলি? এই বেণু, বল না?”
বেণু, অর্থাৎ সেই দুর্মুখ সবজান্তা ছোকরা ভুরু কুঁচকে খবরের কাগজ দেখছিল। একদম ভেতরের পাতা, চেয়েচিন্তে পাওয়া। অন্যমনস্ক ভাবে বলল - “হুঁ”
উত্তেজিত তরজাটা খানিক হতাশ হল। কেউ একজন বলে উঠল
“বেণু তোর পরীক্ষা শেষ কবে হবে রে? চল, বম্বে ঘুরে আসি একবার। তোর বড়মামা আছে না ওখানে? চল যাই, কাকাকে একবার দেখতে পাই যদি!”
নিরুত্তর বেণুর আগেই তড়বড় করে উঠল আরেকজন।
“বেণুর মামাবাড়ি বম্বেতে তো তোর কাকার কি রে শালা!
“আরে এ কাকা আমাদের কাকা, রাজেশ খান্নার কথা বলছি!”
“ও গেলে ওর মামার কাছে যাবে, রাজেশ খান্না ওর মামা নাকি? অত সোজা? তাহলে তো এরোপ্লেনও পাখি রে! এই বেণু, কী অত পড়ছিস? চালের দাম আবার বাড়ছে নাকি?”
“আরে বেণু পরীক্ষার পড়া করছে মনে হয়”
“ওসব পরীক্ষা টরীক্ষা সব ঢপ। বাপ বলেছে এই শেষ, আর পড়ার খরচ দেবে না। কুলোতে পারছে না। একটা চাকরি কোথায় পাই বল তো?”
“এই পেনে যতক্ষণ কালি থাকবে ততক্ষণ আজ চাকরির দরখাস্ত লিখব। আজ আমি সারাদিন নড়ছি না। এই একটা কাউন্টার দেব, এদিকে বিড়িটা দে তো।”
গজল্লার মধ্যে একমাত্র নীরব পাঠক বেণু খবরের কাগজটা ছুঁড়ে ফেলল। রমাদাটা বড্ড ভালো পড়াত। হরলিক্সের শিশির মত মোটা কাঁচের চশমা, সাংঘাতিক পাওয়ার। কমিউনিজমটা ভালো বুঝত, বোঝাত একঘর। গতমাসের পরে আর পড়াতে আসেনি। মাইনেও নেয়নি। আর আসবেও না। আসতে পারলে তো আর খবর হত না। আসবে না বলেই রমাপতি সান্যাল আজ খবরের কাগজের পাঁচের পাতায় চার লাইনে খবর হয়েছে। দুষ্কৃতি সন্দেহে পুলিশের গুলি! দূর, রমাদাটা মরে গেল?
গজল্লাটা এতক্ষণে হিন্দি বাংলা খিস্তির তুলনামূলক গবেষণায় ঘুরছিল, হঠাৎই একটা বাজখাঁই চিৎকারে হোঁচট খেল।
“অ্যাই প্রণব, অ্যাই প্রণব। প্রণব! চায়ের দোকানে ফস্টিনস্টি হচ্ছে? আজকের দিনে এখন এখানে বসে আড্ডা হচ্ছে হতভাগা!”
গজল্লা এতক্ষণ যতই যাই গবেষণা করুক, তীর্থপতির অঙ্কের রাশভারী স্যার এসে তাতে যোগ দেবেন সে কেমন কথা! গবেষকরা এদিকে ওদিকে ছিটকে গেল। মধ্যমণি বেণু চট করে হাতের সিগারেটটা ফেলে চপ্পল দিয়ে নিভিয়ে দিল। স্টীম ইঞ্জিনের মত স্যার সামনে এসে দাঁত খিঁচোলেন।
“হতভাগা ছেলে! আজ যে অঙ্ক পরীক্ষা সে খেয়াল আছে? না কি লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে এই কুলাঙ্গার গুলোর সঙ্গে দিন কাটাবে ঠিক করেছ?”
প্রণব, থুড়ি বেণু সচরাচর চমকায় না। একটু ত্যাড়াভাব বজায় রাখা কর্তব্যবোধে বলল
“আজ নয়, পরীক্ষা তো পরশু।”
বলাই বাহুল্য জীবনের প্রতিটাদিনই অগ্নিপরীক্ষা। কিন্তু স্যার এহেন দর্শনে বিশেষ আস্থা রাখেন না দেখা গেল। পরশুদিন পরীক্ষার প্রস্তাবটাকে হাত নেড়ে মাছির মত উড়িয়ে বললেন,
“বাঁদর ছেলে, পরীক্ষার দিন চেঞ্জ হয়েছে সেটা কি বাড়ি গিয়ে বলে আসতে হবে তোমায়? বলি এ বছর হায়ার সেকেন্ডারি পাশ দেবার ইচ্ছে টিচ্ছে আছে না নেই? আর আধঘন্টা পরে গেট বন্ধ হয়ে যাবে। আমার তো আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই, তোমার মত জ্যাঠা ছেলেদের-”
স্যারের প্রশংসা শেষ হবার আগেই বেণু চিলের মত ছোঁ মেরে দরখাস্তকারীর চাকরির পেনটা হাতিয়ে বলল,
“যাচ্ছি স্যার, এক্ষুণি যাচ্ছি।”
গজল্লাটা হাঁ করে দেখল ছোকরা খোলা ডটপেন হাতে ছুটছে হায়ার সেকেন্ডারির অঙ্ক পরীক্ষা দিতে। রাশভারী স্যার গজগজ করতে করতে স্কুলের দিকে হাঁটা লাগাচ্ছেন।
এই গজল্লাটা দেখতে পায়নি ছোকরার দৌড়টা কত লম্বা ছিল। সব পরীক্ষায় কি আর লেটার আসে! সেবার অবশ্য লেটার হয়েছিল। পরে সে ছোকরা নিজেই অন্য ছেলেমেয়েদের অঙ্কে লেটার পাওয়ানোতে মন দিয়েছিল।
এই গল্প হতেই পারে মনগড়া। এই গল্প যার সে নিজেই চলে গেছে আজ বারো বছর। এক যুগ! সে নিজেই এইসব ছাইপাঁশ লেখা দেখলে মুচকি হাসত নিশ্চিত। তবে তাই বলে কি আর গল্প সত্যি হয় না? আজও যখন যেখানে কোনও কিশোর ঘাড় বেঁকিয়ে তর্ক জোড়ে, ঠোঁটকাটা জবাব দেয়, আপোষ করতে বললে পাপোশ করে দেয়, আমি যেন তাকেই দেখি। সেই শোনা গল্পের চেনা কিশোর।
বেণু, আমার বাবা।