ভাষ্য
আকাশ আপাতত অফিসিয়ালি নীল সাদা, যদিও থেকে থেকে কালো ছাই মেঘ ঘনিয়ে এসে ব্রেকিং নিউস তৈরি করছে। মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন হলো, ট্রাফিক সিগন্যাল থেকে বারোয়ারি পুজোর মাইকে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র কি মহিষাসুর-মর্দিনী অ্যানাউন্স করেছেন?
“আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক-মঞ্জীর;
ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা;
প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমন বার্তা।”
পুজো এসে গিয়েছে, তাই না? বিশেষ সূত্রে খবরে প্রকাশ এই বছরেও উত্তাল তর্ক লাগল বলে! শুভ মহালয়া বলে উইশ করাটা কি যুক্তিযুক্ত হচ্ছে? আমরা কি সত্যিই মহালয়া?
ওরকম একটু আধটু বাওয়াল ছাড়া পুজো মশাই ইনকমপ্লিট থেকে যায়। এই মহালয়া নিয়ে কম বিতর্ক হয়েছে? বাঙালির ম্যাটিনি আইডল অবধি ছাড় পান নি।
১৯৭৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর। মহালয়ার ভোরে চির পরিচিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী'র সুর বাজলো না আকাশবাণীতে। প্রচারিত হলো বিকল্প অনুষ্ঠান 'দেবিং দুর্গতিহারিনীম'।
জরুরি অবস্থার সময় রেডিয়োতে নানা ধরনের নতুন অনুষ্ঠান করার জন্য কেন্দ্র থেকে নির্দেশ আসত। কলকাতায় হুকুম জারি হয় মহালয়ায় কিছু নতুন করতে হবে। বাংলার অন্যতম সুরকার অসীমা মুখোপাধ্যায় প্রযোজক হিসেবে নিয়ে আসেন বাংলা এবং মুম্বইয়ের তারকা খচিত মহালয়ার নতুন অনুষ্ঠান 'দেবিং দুর্গতিহারিনীম'।
বলাই বাহুল্য শিল্পীদের যে পরিমাণ শ্রম, অধ্যবসায়, টানা রিহার্সাল এবং বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের অমর কণ্ঠের জাদু ‘মহিষাসুরমর্দিনী' কে বাঙালির হৃদয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিল, এমারজেন্সির হাওয়ায় তড়িঘড়ি নির্মিত অনুষ্ঠানে তার ছিটে ফোটাও ছিলো না। এর মধ্যে আবার জোর গুঞ্জন শুরু হলো, অব্রাহ্মণ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠ ক্যানসেল করে হিন্দু ব্রাহ্মণ নেতাদের টিকিতে তেল মারা হয়েছে। কি কাণ্ড!
আম বাঙালি বেজায় চটে উঠল। মাঝখান থেকে দেড় ঘণ্টার অনুষ্ঠানে সাকুল্যে আড়াই মিনিটের ভাষ্যপাঠ করে জনতার রোষের মুখে পড়লেন মহানায়ক স্বয়ং।
অনুষ্ঠানখানা লোকমুখে চাউর হয়ে গেল উত্তমকুমারের মহালয়া নামে। আর প্রতিবাদ? বারোয়ারি মণ্ডপে মণ্ডপে সে বছর মাইকে আর পুজোর কোনও গান নয়, বাজল মহিষাসুরমর্দিনী।
এর পর উনপঞ্চাশ বছর কেটে গেছে, পরিবর্তন এসেছে পরিবর্তন গিয়েছে, থেকে গিয়েছে বাঙালির ঘাড় ত্যাড়া জেদ আর মহালয়ার ভোরে মহিষাসুরমর্দিনী। ওই, যা কিছু
সর্বজনীন তা ঠিক আগলে রাখে সর্বজনে?
এই বারোয়ারি দুর্গাপুজোও তো বিদেশি শাসকের চোখ রাঙানিকে কাঁচকলা দেখিয়ে একদিন গুটিকতক পয়সাওয়ালা উচ্চঘরের বাইরে এসে হয়ে উঠেছিল সর্বজনীন! সে ইতিহাস ভুললে চলবে? নাকি বাঙালি তার সর্বজনীন বারোয়ারি উঠোনে পট, সং, পুতুল, খেউড়, হাফ আখড়াই, পুজোর গান থেকে আজ থিম পুজো অবধি বাঁচিয়ে রেখেছে তার শিকড়ের ডিএনএ?
তাহলে আমরা টাইম মেশিনটা বার করি? গন্তব্য এখন ১৯২৬ সাল।২রা এপ্রিল। পরাধীন ভারত, টেগার্টের কলকাতা।‘বীরাষ্টমী’ উৎসব উপলক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে সিমলা ব্যায়াম সমিতি।শরীরচর্চা, লাঠি খেলা, ছুরি খেলার মতন বাংলার প্রাচীন মার্শাল আর্টস শেখানোর উদ্যোগ নিয়ে এলেন বিপ্লবী অতীন্দ্রনাথ বসু। সেই বছরেই সিমলা ব্যায়াম সমিতির মাঠে শুরু হলো সর্বসাধারণের জন্য দুর্গাপুজো।এরই কাছাকাছি ১৯২৭ সালে পুরুলিয়ায় উচ্চবর্ণের পুজো মণ্ডপে গরিব নিম্নবর্ণের মানুষকে ঢুকতে না দেওয়ায় স্থানীয় মানুষের মনে ক্ষোভ জন্মায়। তৈরি হয় সর্ব সাধারণের জন্য দুর্গাপুজোর দাবি।
সার্বজনীন পুজো, যাতে জাত-ধর্মের পরোয়া না করে, আর্থিক বৈষম্যকে অস্বীকার করে সর্বস্তরের মানুষ একত্রিত হতে পারে। যাতে বাঙালির বারোয়ারি ঐতিহ্যের সং পুতুল
ফের ট্রেন্ডে নিয়ে এসে পুতুল ও পোস্টার টাঙ্গানো যায়। এই পুজোর সুবাদে পলাশির যুদ্ধ থেকে সিপাহি বিদ্রোহ পর্যন্ত ভারতের মুক্তি আন্দোলনের অসংখ্য ঘটনা উঠে আসে আম জনতার চোখের সামনে। মা যা ছিলেন। মা যা হইয়াছেন। নিষিদ্ধ উপন্যাস আনন্দমঠ থেকে উদ্ধৃত করে পোস্টারিং হবে ‘বাহুতে তুমি মা শক্তি হৃদয়ে তুমি মা ভক্তি, তোমারি প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে’।
ফলে ব্রিটিশ পুলিশ ও তাদের চ্যাম্পিয়ন কমিশনার টেগার্ট স্যারের নাকের ডগায় বছর বছর সর্বজনীন থিম হয়ে আসতে লাগল বাঘা যতীনের লড়াই, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন এইসব ভয়ানক দ্রোহের কাণ্ড। তবে কিনা ব্রিটিশ পুলিশও তক্কে তক্কে ছিলো।
১৯৩০ সালে বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের দুই বিপ্লবী নারায়ণচন্দ্র দে ও ভূপাল বসু বোমা মারেন কমিশনার টেগার্টের গাড়ি উদ্দেশ্য করে। প্রাণে বেঁচে গেল টেগার্ট। ধরা পড়ে গেলেন দুই বিপ্লবী। শুরু হল ডালহৌসি স্কোয়ার বোমা মামলা। নারায়ণচন্দ্র দে আবার ছিলেন সিমলা ব্যায়াম সমিতির অন্যতম সংগঠক। ফলে সিমলা ব্যায়াম সমিতিকে বেআইনি ঘোষণা করা হলো ১৯৩২ সালের ৭ অক্টোবর। এই নিষেধাজ্ঞা উঠে যায় ১৯৩৬ সালে। দুর্গাপুজো ফিরে আসে ব্যায়াম সমিতির মাঠে। জাতীয়তাবাদী আন্দোলন থিম নিয়ে অবশ্যই। বাঙালি কবে নিষেধ মেনেছে বলুন দেখি?
সর্বজনীন বা সার্বজনীন - অর্থাৎ সর্বজনের দ্বারা, সর্বজনের জন্য। অনেকটা আমরা সবাই রাজার মতন বেশ ইনক্লুসিভ শুনতে। তাই না? উল্টোদিকে বারো ইয়ার থেকেই নাকি বারোয়ারি। এই ইয়ার দোস্ত ব্যাপারটা শুনতে একটু ফস্টি নষ্টি লাগে কিন্তু।
সেটা নিয়েও তর্ক আছে। বার নাকি বাহির বা সবার জন্য অর্থেও ব্যবহার হয়। আর ফারসি শব্দ ওয়ারি অর্থ হলো অনুযায়ী। কী? বারোয়ারি আর সর্বজনীন এক হলো? তলিয়ে ভেবে দেখলে এই যে রাজবাড়ির দুর্গাদালান কিংবা শ্বেতপাথরের মন্দির ছেড়ে, সোনার প্রতিমা, পাথরের মূর্তি ছেড়ে, রাজকীয় জাঁক জমক ছেড়ে চিন্ময়ীর মৃন্ময়ী হয়ে ওঠার মধ্যে, যুদ্ধের দেবী দুর্গা থেকে ঘরের মেয়ে উমা হয়ে ওঠার মধ্যে মাতৃপূজক বাঙালির সেই ঘাড় ত্যাড়া দ্রোহের লেগ্যাসিই কি স্পষ্ট হয়ে ওঠে না?
বাঙালির বরাবর এক অভ্যেস তার প্রাণের দেবী, হৃদয়ের ঠাকুরকে মানুষ মানুষীর গল্পে এনে ফেলা। কৃত্তিবাস তাঁর রামায়ণ গানে যেমন রামচন্দ্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন আপামর বাঙালির, সেই শ্রী রামচন্দ্র এক অশ্রুমুখী নরম স্বভাবের বাঙালি বই অন্য কিছু তো নন। সীতা হারিয়ে তিনি হাহাকার করে বলেন “সীতা বিনা আমি যেন মণিহারা ফণী”। শারদ উৎসবের অকাল বোধনও সেই সূত্রে চিনল বাঙালি, যা কিনা বাল্মীকি রামায়ণের সিলেবাসেই নেই।
বাল্মীকির সিলেবাসে তো এও নেই যে এই অকাল বোধনের জন্য রাজা সুরথের মতন শ্রী রামচন্দ্র নিজে মাটির মূর্তি তৈরি করে পুজো করতে বসেছিলেন।ষষ্ঠীর সন্ধ্যাবেলা বেল গাছের তলায় হবে দেবীর বোধন। অধিবাসের সময় রামচন্দ্র হাতে বেঁধে দেবেন নবপত্রিকা। আদ্যোপান্ত বাঙালি বারোয়ারি পুজো সে ধর্মঠাকুরের হোক কি মা মনসার, শস্য শ্যামলা উর্বর মাটির দেশে হাজার বছর ধরে এভাবেই ব্রাহ্মণ-প্রধান বর্ণপ্রিয় উঁচুঘরের রীতিনীতির সমান্তরালে বাঙালি থেকে গিয়েছে সংঘবদ্ধ মাতৃসাধক জাতি হয়ে। যুদ্ধের দেবী যে অচিরেই তাদের কুঁড়েঘরের আদরের দুলালী হয়ে বছরে একবার গরিব চালচুলোহীন বরের ঘর ছেড়ে বাপ মার কাছে চারদিন জিরোতে আসবে এ আর নতুন কথা কী?
বাঙালির উৎসব উদযাপন কি তবে কেবল করুন সুরে বাঁধা? বালাই ষাট! তিনশো বছরের বিদেশি শাসন, মন্বন্তর, দুর্ভিক্ষেও বাঙালি রসবোধ হারিয়েছে এ দুর্নাম বোধহয় স্বয়ং চার্চিলও করবে না। দুর্গোৎসব বাঙালিকে দিয়েছে তার শিকড়ে গাঁথা আরেক অধিকারের যাপন- যা কিনা আমরা জানি মোচ্ছব নামে। পলাশীর যুদ্ধের পর বাবু সমাজের উত্থানের সেই সময়ে হুতোম কলকাতার বারইয়ারি পুজো নিয়ে কী বললেন?
কলকাতার নব্য বারোয়ারিতলা বাবুদের দাক্ষিণ্যে কালচারে একেবারে থইথই করছে। কলকাতার রাস্তাঘাটে মণ্ডা মিঠাই দুধ গড়াগড়ি যাচ্ছে, সঙ্গে নেশার দ্রব্য তো আছেই। রাতভর জলসা, গান, বাজনা চলছে। অথচ এই বঙ্গেই না খেয়ে মন্বন্তরে উজাড় হয়ে যাচ্ছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ এই একই সময়ের এপিঠ ওপিঠে। কি অদ্ভুত কন্ট্রাস্ট, তাই না?
দেদার অপচয় করার মতন উদ্বৃত্ত যখন গুটিকয় মানুষের হাতে আসে বুঝে নিতে হয় বহু মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে তাদের সব জানমাল জমা দিয়েছে সেই গুটিকয়েকের হাতে। তাই অপচয়ের অশ্লীল লাক্সারি সম্ভব হয়েছে। হুতোম বলছেন -
“নবাবি আমল শীতকালের সূর্যের মতো অস্ত গেল। মেঘান্তের রৌদ্রের মতো ইংরাজদের প্রতাপ বেড়ে উঠল। বড় বড় বাঁশ ঝাড় সমূলে উচ্ছন্ন হলো। কঞ্চিতে বংশলোচন জন্মাতে লাগল। নবো মুন্সি, ছিরে বেনে ও পুঁটে তেলি রাজা হলো।”
নাম চেনা চেনা লাগছে? হুতোমের নকশা রহস্য সমাধান করবেন আসুন? নইলে এই যে টাইম মেশিনে চেপে সময় আগু পিছু করছেন তার জ্বালানি খরচ উঠবে কেন?
শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেব গভর্নর ড্রেকের মুন্সি ছিলেন, সেটা বড় কথা নয়। তিনি ওয়ারেন হেস্টিংসের হোম টিউটর ছিলেন, তাঁকে ফার্সি ভাষা শিখিয়ে সিরাজের পাশা উল্টোতে মদত করেছিলেন, যার প্রাইজ হিসেবে তিনি রাজা বাহাদুর খেতাব এবং ছয় হাজারি মনসবদারী পান। হেস্টিংস ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে সুতানুটির তালুকদারি দেন। এইটে হলো আসল কথা।
ছিরে বেনে? কলকাতার পোস্তা রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা লক্ষ্মীকান্ত ওরফে নকু ধর। ক্লাইভ ও হেস্টিংসের কাছের লোক, নবকৃষ্ণ দেবের সঙ্গে ইনিই তাঁদের পরিচয় করিয়ে দেন।
পুঁটে তেলি? আমাদের আগের এপিসোডের কান্তবাবুকে মনে নেই? সেই যে, হেস্টিংসকে পচা পান্তা খাইয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন, নবাবের সেনার নজর থেকে লুকিয়ে রাখার জন্য? কাশিমবাজারের রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা কৃষ্ণকান্ত নন্দীর কথাই হচ্ছে। ওয়ারেন হেস্টিংসের খাস দেওয়ান, সঙ্গে নুন, রেশম নিয়ে কোম্পানির মনোপলি তৈরির কারিগর। মনে রাখবেন, এই নুন, এই রেশম বহু প্রজন্ম ধরে বাঙালি ব্যবসায়ীদের সর্বস্ব লুটে নিয়ে গিয়েছে।
এর চেয়ে বড় নকশা কোথায় পাবেন বলুন দেখি? পলাশীর যুদ্ধের পর কলকাতায় বাবুদের জাঁক দেখিয়ে মুখ রক্ষে করার একরকম বন্দোবস্ত হয়ে গেল দুর্গাপুজো দিয়ে। কিন্তু দুর্গাপুজো কবে থেকে বাঙালির হলো তাই নিয়ে প্রশ্ন যে সমাধান হলো না? বারইয়ারি দুর্গাপুজোর আগে এ বঙ্গে দেবী দুর্গার পুজো হত বুঝি?
সে কথাই যদি উঠল তবে টাইম মেশিনে চেপে আমাদের আরেকটু পিছিয়ে যেতে হবে সেই পাঁচশো বছর আগে। মোগল সম্রাট আকবর বনাম বারো ভূঁইয়ার লড়াই, প্রতাপাদিত্যের হার, আর একটি ছেলে ভুলনো ছড়া।
ইকিড় মিকিড় চাম চিকিড়
চামে কাটা মজুমদার
ধেয়ে এল দামোদর
দামোদরের হাঁড়ি কুড়ি,
গোয়ালে বসে চাল কাড়ি...
এই ছড়া নিয়ে একটা রাজদ্রোহের গল্প শোনা যায়। তখন বাংলার বারভুঁইয়া রাজারা জোট বেঁধে আকবরকে রাজস্ব দিতে অস্বীকার করছেন। মেছো বাঙালি বরাবর ঘাড়ত্যাড়া কিনা! অবাধ্য এই বারো ভূঁইয়াদের দমন করতে সেনাপতি মানসিংহকে বাংলায় পাঠালেন আকবর। কিন্তু মানসিংহ পড়লেন অকূল পাথারে। প্রতাপাদিত্য, কেদার রায়ের মত রাজাদের হারাবেন তেমন এলেম কৈ? এইসময় ভবানন্দ মজুমদার মানসিংহকে প্রতাপাদিত্যের ভেতরের খবর সরবরাহ করলেন। ইতিহাস বলছে তাঁর আসল নাম ভবানন্দ সমাদ্দার, তখন রাজস্ব আদায়ের লোকেদের মজুমদার বলা হত। ইনি হলেন কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষ ভবানন্দ মজুমদার।
তা ভবানন্দ মানসিংহকে নৌবহর জোগাড় করে দিয়ে দামোদর নদ পার করালেন। মোগল সেনার খাবার, রসদও জোগাড় করে দিলেন । এরপরই বারো ভূঁইয়াদের পতন, বাংলার সুবাদার হলেন মানসিংহ।
ছড়া বলছে চামড়াহীন অর্থাৎ নির্লজ্জ মজুমদারের জন্যই দামোদর দিয়ে আকবরের সেনা ধেয়ে এল। তারপর? চাল কুটতে হল বেলা। ভবানন্দ মান ইজ্জত রাখতে একটা জুতসই যজ্ঞ খুঁজলেন, ওই অশ্বমেধ, রাজসূয় যজ্ঞ আর কি। কিন্তু সে রামও নেই আর সে অযোধ্যাও নেই। এসব যজ্ঞ তখন নিষেধ। এক আছে দুর্গাপুজো। কৃত্তিবাসী রামায়ণ ছাড়াও ততদিনে এই পুজোর বিধি আচার নিয়ে বই লিখেছেন বহু স্মার্ত পণ্ডিত। সাধারণ গৃহস্থ ঘরে তখনকার হিসেবে কুড়ি পঁচিশ টাকা দিয়ে যে পুজো সম্পন্ন হত, তার রাজকীয় পালন হলো আট লক্ষ টাকা খরচ করে।
আট লক্ষ টাকা? ইয়ে মানে তখন তো গান্ধীনোট ছিলো না, তাহলে কিনা কাঁচা টাকা, যারে কয় আকবরী মোহর? আট লক্ষ মোহর দিয়ে পুজো করলেন ভবানন্দ মজুমদার?
ওই একই সময় একই রকম খরচ করে দুর্গাপুজো করেছিলেন কংস নারায়ণ রায়, যিনি কিনা মনুসংহিতার প্রসিদ্ধ টীকাকার কল্লুক ভট্টের পুত্র। মানসিংহকে সাহায্য করেছিলেন তিনিও। রাজকীয় দুর্গাপুজোর প্রবর্তন করবেন না, তা কি হয়?
অথচ বাংলায় কি এর আগে রাজা ছিলেন না? তাঁরা কখনও দেবীপূজা করেননি?
সেকথা বললে বাংলার জল বাংলার মাটির গানই বৃথা, শাক্ত ধর্মের উপাসনার প্রাচীন রীতিও মিথ্যে হয়ে যায়। এই প্রসঙ্গে ইছাই ঘোষের কথাটা আমরা ভুলি কেমন করে? ধর্মমঙ্গল কাব্যের অন্যতম চরিত্র গড় জঙ্গলের রাজা ইছাই ঘোষ ছিলেন দেবীর উপাসক। বাউরি বাগদি ডোমদের দুর্দান্ত সৈন্য নিয়ে ইছাই ঘোষ রাঢ়ভূমে কর্ণসেনের সঙ্গে টক্কর দিয়ে স্বাধীন গোপরাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ইছাই ঘোষের আরাধ্যা ছিলেন শ্যামরূপা দেবী। ইছাই ঘোষ দেবীকে কি নামে ডাকতেন তা আর ইতিহাস মনে রাখে নি। তাঁর তো আর সভাকবি ছিলেন না, যিনি গীতগোবিন্দ লিখে অমর হয়ে থাকবেন? বখতিয়ার খিলজি যখন বাংলা আক্রমণ করেন, তখন লক্ষণ সেন এই জঙ্গলেই আশ্রয় নেন। কথিত আছে, কবি জয়দেব দেবীর নাম রেখেছিলেন শ্যামরূপা, হয়ত তিনি রাজা লক্ষণ সেনের সঙ্গেই এসেছিলেন? আরও আশ্চর্য দেখুন, এই গড়জঙ্গলেই প্রথম দুর্গাপূজো করেছিলেন রাজা সুরথ। সেই রাজা সুরথ, যিনি কৃত্তিবাসী রামায়ণে শ্রী রামচন্দ্রের অকাল বোধনের পথ প্রদর্শক। কোথাকার জল কোথায় রেখেছ? ডোম বাগদি বাউরিদের আদি দেবী কেড়ে তাদের জল অচল করে তাদেরই মাতৃপূজার অঞ্জলির অধিকার থেকে কত জন্ম দূরে সরিয়ে রাখতে পারত মনুবাদী ব্রাহ্মণ্যধর্ম?
সর্বজনীনে সেই মাতৃপূজার অধিকার ফিরিয়েই আনল বাঙালি, জাতি ধর্ম ভেদাভেদ ভুলে। স্বাধীনতার লড়াই, মন্বন্তরের খিদে, দেশভাগের দগদগে ক্ষত থেকে আজ বাংলাভাষী মানেই বাংলাদেশী তকমার ট্রেন্ড - দেখুন দেখি, বাঙালির মুকুটে বরাবরই পালক কম, কাঁটার ভাগটাই বেশি। তাও আমরা হাজার ভন্ডামি পেরিয়েও শিকড়ে শহর মফস্বল গ্রাম অভেদে কি সেই মাতৃপূজকই রইলাম?
এর উত্তর জানে গুপ্তিপাড়ার পুজো। সেই যে, বিখ্যাত সেনবাড়িতে দুর্গাপুজোর সময় স্থানীয় সাধারণ মানুষ অঞ্জলি দিতে পেলেন না। বারোয়ারি উদ্যোগে সেই বছরেই বঞ্চিত সাধারণ মানুষ দেখিয়ে দিলেন মাতৃপূজো কেবল রাজা গজাদের নয়।
১৭৫৯ খ্রিষ্টাব্দে স্থানীয় বিন্ধ্যবাসিনী মন্দিরে শুরু হলো প্রথম সার্বজনীন পুজো, ইতিহাসে যা লেখা হয়ে থাকল প্রথম বারোয়ারি পুজো হিসাবে। যা ইতিহাসে লেখা হয় নি?
বাংলার সেসব দ্রোহকালের সুলুক সন্ধান জানে রাঢ়ভূমের জঙ্গল। আজও গভীর জঙ্গলের মধ্যে শ্যামরূপা দেবীর মন্দিরে মহাষ্টমী পুজোর আগে নাকি বাঘের ডাক শোনা যায়। বহু দিক থেকে মানুষ আসেন সে ডাক শুনবেন বলে। হয়ত মিথ, হয়ত তান্ত্রিকদের ব্যাঘ্রনাদের গুপ্তবিদ্যা! বিশ্বাসীরা বলেন সবই সিংহস্থা শশিশেখরার মহিমা। কাছেই আছে দেবী চৌধুরানীর গুহা মন্দিরের গুপ্ত পথ। কোম্পানির বিরুদ্ধে মাথা তোলা সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহের দেবী চৌধুরানী, ঐতিহাসিকদের মতে যাঁর নাম জয়দুর্গা। স্থানীয়দের কাছে জ্যান্ত দুর্গা। আমরা বলি এ আমাদের বাংলার ইতিহাস। কখনও ফিসফাস করে, কখনও গর্জন করে ওঠে, কখনও লুকিয়ে পড়ে মেটাফর, হেয়ালি, নকশা, সং, পুতুল, থিমপুজোর আড়ালে। শুধু মুছে যায় না। অব্রাহ্মণ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ আজও মহালয়ার ভোরে - বিশ্বেশ্বরী ত্বং পরিপাসী বিশ্বম্ বলতে বলতে ঝরঝর করে কাঁদেন, সেই শিশিরে শিউলি ফোটে।
মা যা ছিলেন। মা যা হইয়াছেন। মা যা হইবেন।
আমাদের ভাষা, ইতিহাস, অস্মিতার এই সব বারোয়ারি উত্তরাধিকার থাক, অন্ন বস্ত্র মাটির স্বাধীনতা অক্ষুন্ন থাক, এটুকুই আশা। আমরা মনে রাখি অন্নের সুষম বন্টনেই মঙ্গল।
প্রকৃত ধর্মমঙ্গল!
ধাঁধা
বারো মাসে তেরো পার্বণ
এ কথা তো জানে সবাই
বারো ঘর এক উঠোনে
তাও পাহাড়ে মেয়ের ঠাঁই
তথ্যসূত্র
বই
- সটীক হুতোমের নকশা. অরুণ নাগ
- মহেন্দ্রনাথ দত্ত. পুরাতন কলিকাতার কাহিনি ও প্রথা
- শিবশঙ্কর ঘোষ. বঙ্গের শারদোৎসব ও ব্যতিক্রমী দুর্গাপূজা
প্রবন্ধ
- রক্তবিন্দু দিয়ে উদ্ধার হবে ‘স্বাধীনতার ধন’—এই বার্তায় শুরু ‘প্রথম’ সর্বজনীন দুর্গোৎসবের. প্রহর ডেস্ক
- সন্ন্যাসী বিদ্রোহ
- প্রীতম নস্কর. গুপ্তিপাড়ার ঐতিহ্য ও সমাজসংস্কৃতি । Tradition and Socio-Culture of Guptipara
- সিমলি রাহা. মা দুর্গাকে দেখার অনুমতি ছিল না সকলের, সেই রাগ থেকেই জন্ম হল বারোয়ারি দুর্গা পুজোর
- ছড়ার ছন্দে বাংলার ইতিহাস