ভাষ্য
ধর্মমঙ্গল আর রসমঙ্গল মিলে যাবার জন্য বাঙালির পাঁজি তিথি তো আর লাগে না? তাও, নেহাত যদি শুভ মুহূর্তের খোঁজ পড়েই যায়?
তাহলে আর কি! ক্যালেন্ডারে দুর্গাপুজো কবে পড়েছে সে খোঁজ তো গত বিজয়া দশমী থেকেই লোকজন রাখতে লেগেছে, তাই না? শুভ বিজয়ার শুভেচ্ছার সঙ্গে পুজোর আর দেরি মাত্র তিনশো সাতষট্টি দিন চার ঘণ্টা পঞ্চান্ন মিনিট মর্মে যদি মেসেজ না পেয়ে থাকেন তবে মশাই আপনার ভার্চুয়াল সমাজ বড়ই বেরসিক।
আচ্ছা সেসব সমাজ বিরোধী রসিকতা বরং আজকের মতো মুলতুবি থাক? আপাতত পুজোয় কপালে কী নাচছে বলুন দেখি?
দুর্ যদি হয় তরাস লেগে যায়
দর্শন যদি হয় বিঘ্ন দূরে যায়
জাতি জনতা একত্রে বসে খায়
ভোগ, উফ শুনলেই সুড়ুত জিভে জল মুখে হাসি , অষ্টমীর খিচুড়ি খেতে বেজায় ভালবাসি। আজ শারদীয়া কথকতায় ভোগ তো থাকছেই, সঙ্গে দুর্ভোগ, উপভোগ, সম্ভোগ নিয়েও দু চার কথা হয়েই যাক? চিন্তা নেই। ডাকাত, যুদ্ধ এমনকি গুপ্তধনও থাকবে। নইলে দুর্গাপুজোর সাতকাহন হবে কেমন করে?
প্রথমেই একটা কথা পরিস্কার করে দিতে চাই। আমরা কিন্তু মোটেও সিনেমার রিভিউ দিতে বসিনি। আজকের কথকতা এমন সব গল্প নিয়ে যা কিনা সিনেমাকেও হার মানবে। সে গল্প কতটা সত্যি, কতটা ইতিহাস সে না হয় শুনতে শুনতে আমরাই ঠিক করে নেব?
দুর্গাপুজোর সাতকাহন শুনতে আর শোনাতে কে না ভালোবাসে বলুন? অসুরবধ রাবণবধের উৎসব একদিকে, আর ঘরের মেয়ে গৌরীর শ্মশানচারী বরের ঘর ছেড়ে এসে চারদিন বাপ মায়ের আদরে জিরিয়ে নেওয়া আরেক আনন্দ উৎসব। মহামায়া জগন্মাতাকে আদরের দুলালী উমা বলে কাছে পাওয়ার এই চারদিন ভালোমন্দ খেয়ে পরে ঠাকুর দেখে না বেড়ালে হয়?
বেশ, দুর্গাপুজো মানে তাহলে ভালোমন্দ খেয়ে বেড়ানো, তাই তো? তাহলে ভোগ দিয়েই শুরু হোক? কিরকম ভোগের কথা বলছি আমরা? ভেজ না নন ভেজ?
অনেকে বলবেন ভোগ আবার আমিষ কী? রীতিমত দীক্ষা নিয়ে শুদ্ধাচারে ভোগ রাঁধতে হয়। গোবিন্দভোগ চালের খিচুড়ি, পাঁচ রকম ভাজা, লাবড়া আর পরমান্ন। সন্ধিপূজোয় গাওয়া ঘিয়ের লুচি আর মোহনভোগ। এ তো কঠোর নিরামিষ!
সে তো পুরো নবরাত্রিই নিরামিষ রাখার ফরমান এসেই চলেছে। তাই বলে নবমীর দিন পাঁঠার মাংসের দোকানে লাইন আজও কমছে কি? নোলার সঙ্গে ধর্মের বিরোধ শেষ অবধি বাঙালির রসনায় ঠাঁই করতে পেরেছে? ভুলে যাব দশমীতে পান্তা আর মাছ খাইয়ে মেয়েকে বিদায় দেবার প্রথা? বৈষ্ণব মতের পুজোয় মাছ ভোগ দেবার গল্প? শাক্তভূমিতে মাতৃপূজক বাঙালি হয়ে বলির গল্প? বলি বন্ধ কোথাও এক কাহিনি। বলি শুরু কোথাও সেও এক কাহিনি। সব কি তাহলে ভুলে যাব? তা কেমন করে হয়?
তা বলির কথাই যদি বলি, সেই বা কেমন? চালকুমড়ো না পাঁঠা? মোষ, না মাছ? নাকি, নরবলি?
আসুন, ভূতমুড়ি চালের ভাত, ডিংলা তরকারি, বিউলির ডাল, আর জিয়োনো চ্যাং মাছের ঝোল দিয়ে ভোগের গল্প শুরু করি।
সময়টা তখন বাংলার ভাগ্যকাশে দুর্ভোগের ঘনঘটার সময়। মহাদুর্যোগের সময়। শুরু হয়েছে খোকা খুকুর ঘুমপাড়ানি ছড়ার দিনকাল।
খোকা ঘুমাল পাড়া জুড়ালো বর্গি এলো দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে
১৭৪২ খ্রিস্টাব্দ, ২৪ শে সেপ্টেম্বর। বাংলায় বর্গী সেনা ঢুকে তছনছ করে দিয়েছে গ্রাম কে গ্রাম। মারাঠা সেনাপতি ভাস্কর পণ্ডিত বর্গী অর্থাৎ কম পয়সায় সেনা মোতায়েন করেছে, দিয়েছে বেলাগাম লুটপাট খুন ধর্ষণের লাইসেন্স। নবাবের সেনাকে ঘোল খাইয়ে অবাধ লুঠপাট করে ভাস্কর পণ্ডিত মস্ত আয়োজন করে বর্ধমানের দাঁইহাটে দুর্গাপুজো করছে। হাজার হাজার ছাগ মোষ বলি হয়েছে। ঘোড়ার পিঠে, নৌকোয় পুজোর জোগাড় এসেছে। ২৮ শে সেপ্টেম্বর। নবমীর সকাল। নবাব বধের বরটা চাইবেন বলে চেলি টেলি পরে জুত করে বসছিল ভাস্কর পণ্ডিত, এমন সময় ঘোড়ার খুরের শব্দ। নবাব আলিবর্দী খাঁ সেনা নিয়ে এসে গুঁড়িয়ে দিলেন বর্গী শিবির।
প্রথমবার বাংলা আক্রমণ থেকে পিছু হটল মারাঠা দস্যু। যদিও এর পর টানা নয় বছর ধরে বারবার বর্গী হানা হবে, কিন্তু ভাস্কর পণ্ডিতের ফেলে যাওয়া সেই পুজো ঘন জঙ্গল হয়ে পড়ে থাকবে দুশো বছর। পরে সর্বজনীন হয়ে সেই পুজো আবার শুরু হয় ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে।
সে হোক, কিন্তু ওই ভূতমারী চালের ভাত আর চ্যাং মাছের ঝোলটা কি হল?
শুরু করেছিলাম ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দ, ২৪ শে সেপ্টেম্বরে। বর্ধমানের দাঁইহাটায় ভাস্কর পণ্ডিত যজ্ঞ করছে। বাঁকুড়ার শালডিহায় তখন কী চলছে?
পঞ্চমীর রাত। জঙ্গল মহল বর্গী হামলার ভয়ে ত্রস্ত। প্রবীণ ডিগর সর্দার রাত জেগে গ্রাম পাহারা দিচ্ছেন। এমন সময় এক আইবুড়ো মেয়ে কোথা থেকে উদয় হলো। এই ঘোর জঙ্গলে আশ্রয় চাই। ডিগর সর্দার পাকা লোক। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেরা করে বুঝলেন গরিব ব্রাহ্মণ ঘরের মেয়ে, কেন ঘর ছেড়েছে কোথায় চলেছে সেসব জমা খরচে তার রুচি নেই। আপাতত রাত্তিরে মাথা গোঁজার ঠাঁই পেলেই মেয়েটি তরে যায়। অগত্যা সর্দার ভূতমুড়ি চালের ভাত, ডিংলা মানে কুমড়োর তরকারি, বিউলির ডাল, আর জিয়োনো চ্যাং মাছের ঝোল রান্নার বন্দোবস্ত করে মেয়েটিকে ভরপেট খাইয়ে শুতে পাঠালেন, নিজে দোরের সামনে পাহারায় রইলেন। যদি বর্গীর তাড়া খেয়েই মেয়ে পালিয়ে বেড়ায় তাহলে তো রাত্রেই হয়ত বর্গীর দলের সঙ্গে ডিগর সর্দারের লাঠির মোলাকাত হয়েই যাবে। ঘুম আর সে রাত্তিরে গ্রামের কারুর ভাগ্যে ছিলো না। খানিক পরেই সে মেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে গল্প জুড়ল। খুব খানিক জ্ঞান দিল বৃদ্ধ সর্দারকে, বর্গীদের রুখবার জন্য জঙ্গল মহল এক হওয়া উচিত, মা বোনেদের ইজ্জত রক্ষার চেয়ে বড় কাজ আর কিই বা আছে এইসব আর কি। ডিগর সর্দার রাত জেগে এত পরামর্শ শুনে ঝিমিয়েই পড়েছিলেন। ভদ্রঘরের মেয়েকে কি আর বোঝাবেন তিনি, লড়াই করতে অস্ত্র লাগে। লাঠি গুলতি দিয়ে বর্গীর তরোয়ালের মোকাবিলা কাহাতক করা যায়? তা হুট করে সে মেয়ে নিজে থেকেই বলে বসল স্রেফ লাঠি দিয়ে বর্গি তাড়ানো যাবে না সে বিলক্ষণ জানে। উপযুক্ত অস্ত্রের খোঁজ সে দিতে পারে।
ব্যাস, যা থাকে কপালে বলে ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই লোকজন নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন ডিগর সর্দার, পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল সেই মেয়ে। দ্বারকেশ্বর নদী পেরিয়ে মহুয়ার ঘন জঙ্গলে গিয়ে তারা দেখল ঢাল তরোয়াল বল্লম ছোরা প্রচুর পরিমাণে জমানো। বর্গীদের অস্ত্র।এখানেই ডেরা বেঁধেছিল তাহলে লুটেরগুলো। তা তারা গেল কই? কেন? মারাঠা দস্যুর ভক্তির উদয় হয়েছে যে! ভাস্কর পণ্ডিতের দুর্গাপুজো হচ্ছে না দাঁইহাটে? সব বর্গী সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়েছে। নিজেদের অস্ত্র শস্ত্র সব এখানে লুকিয়ে রেখে গিয়েছে।
তারপর? নবাবের সৈন্য এসে বর্ধমান থেকে ভাস্কর পণ্ডিতকে বাংলা ছাড়া করল, আর ডিগর সর্দার বিশাল বাহিনী নিয়ে বাঁকুড়ায় মনের সুখে বর্গী খেদালেন। আর সেই মেয়ে?
দেখুন ঠিক যে কি হয়েছিল সেই রানিং কমেন্ট্রি ডিগর সর্দার করতে পারেননি, তিনি যুদ্ধু নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তবে জনশ্রুতি বলে শালডিহায় সেই প্রথম দুর্গাপুজো শুরু হয়। লাল শালুতে মোড়া তরোয়াল নিয়ে ঘট আনতে যাওয়া হয়। এই তরোয়াল হলো ঈশ্বরী মা। দুর্গাপুজোর ভোগে নিবেদন হয় কী বলুন তো? ভূতমুড়ি চালের ভাত, ডিংলা তরকারি, বিউলির ডাল, আর জিয়োনো চ্যাং মাছের ঝোল। রায় ডিগর সর্দারের সেই রাতের অতিথি সৎকারের মেনু, আজও লোকে মনে রেখে দিয়েছে।
বাবা, যুদ্ধু পুজো সব একসঙ্গে। তখন রাজসূয় যজ্ঞ, অশ্বমেধ যজ্ঞ সব তো শাস্ত্রে নিষেধ। বড়মানুষি দেখাতে হলে আছে দুর্গাপুজো। আকবরের সেনাপতি মানসিংহকে সাহায্য করে ভবানন্দ মজুমদার, কংস নারায়ণ রায় দুর্গাপুজো করে আট নয় লক্ষ মোহর খরচ করে তবে জাতে উঠেছিলেন। গত এপিসোডেই আমরা এই নিয়ে খুব গল্প করেছি, মনে আছে তো? এই ভবানন্দ মজুমদারের উত্তপুরুষ নদিয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র। তাঁর রাজ রাজেশ্বরীর পুজো ততদিনে বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। তিনদিনে একশো আটটা সর্ব সুলক্ষণযুক্ত পাঁঠা বলি দিয়ে রাজবাড়ীর পুজো হত। অভ্রের কারুকার্য রাখা হত প্রতিমার সামনে। আর ভোগ? সে তো রাজভোগ! খিচুড়ি, ভাজা, ছেঁচড়া, চাটনি, হালুয়া, পায়েস কি নেই? সপ্তমীতে থাকবে সাতরকমের ভাজা। অষ্টমীতে পোলাও, ভাত, আটরকম ভাজা, মিষ্টি, ক্ষীর-সহ একাধিক পদ। নবমীতে নয়রকম ভাজা, তিনরকম মাছ, ভাত, মিষ্টি। দশমীতে গলা ভাত, সিঙি মাছ, খই, ফল, দইচিঁড়ে। মোটের ওপর এলাহি কাণ্ড।
এই ভাস্কর পণ্ডিতও মনে হয় সেই জন্যই পুজো করতে গিয়েছিল, সে পুজোর তো আর শেষ মেষ দেখা হলো না। তা হোক, বারোয়ারি আসার আগে দুর্গাপুজো সেই বড়মানুষের বড়ঘরের উৎসবই থেকে গেল, তাই না?
তাই বা কি করে হয়! যুদ্ধের দেবী ঘরের মেয়ে হয়ে উঠছেন যখন তিনি কি আর বিত্ত বর্ণ ভেদ করতে পারেন? এখানেই বর্ধমানের কাটোয়ার হাড়িমা কিংবা মুর্শিদাবাদের রঘুনাথ গঞ্জের কোদাখাকি এক হয়ে যান। যুদ্ধে, দুর্ভিক্ষে, মন্বন্তরে মরতে বসা বাঙালির বুক জুড়ে হিন্দু মুসলমান ব্রাহ্মণ শূদ্র পরিচয় মুছে দিয়ে লোকদেবী হয়ে বসার এইসব গল্পই আমাদের শিকড়ে ছড়িয়ে আছে।
কাটোয়ার হাড়িমাকে দিয়ে শুরু করি? মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দেওয়ানের অর্থসাহায্যে শ্যামসুন্দরী ও বিনোদিনী এই দুই হাড়ি বংশীয় নারীর বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু হয়। দেওয়ানসাহেব গত হলে অর্থসাহায্য বন্ধ হয়ে যায়। শ্যামসুন্দরীর নাতবউ সৌদামিনী অর্থকষ্টে পড়ে ঠিক করেন আর দুর্গাপুজো করবেন না। এমন সময়ে এক সম্ভ্রান্ত ঘরের কিশোরী কন্যা এসে অন্ন ভিক্ষা চাইল। এদিকে ঘরে আছে কেবল পান্তাভাত। উঁচু বাড়ির মেয়ে যতই অভাবী হোক, পান্তাভাত কি আর দেওয়া যায়? কিন্তু সে ছুঁড়িও নাছোড়। ঢের ইতস্তত করে শেষে ঘর থেকে পান্তার হাঁড়ি এনে সৌদামিনী তো তো তাজ্জব! সে মেয়ে গেল কই?
মেয়ে ফিরল, সৌদামিনীর স্বপ্নে। বিনুনি দুলিয়ে সে বলল, দুর্গাপুজো বন্ধ করার জো নেই। উপাচার সাধারণ হোক না? পোলাও মন্ডা নাই হোক, বাগানের থোড়টা, মুলোটা আছে তো নাকি? পুরুষ্টু পাঁঠা না হোক, মাচার চালকুমড়োই সই? সোনা রুপো কাঁসার বাসন দরকার নেই, জমকালো মূর্তি দরকার নেই।
তালপাতার টাটে ঘটে পটে হোক পুজো।
দিকে দিকে চাউর হয়ে গেল জাগ্রত হাড়িমায়ের লীলা কাহিনি। দুর্গাপুজো চলল আরও কয়েক প্রজন্ম। এবার সৌদামিনীর নাতবউ মণিমালা আবার বেঁকে বসলেন। এসব রাজা গজার পুজো কি চাট্টি খানি কথা? কাজ নেই মেলা খরচে। সে বছর মূর্তির বায়না দিতে কাউকে পাঠালেন না তিনি। কি আশ্চর্য, পুজোর আগে পটুয়া এসে হাজির। হাড়ি বাড়ির দুগ্গা পিতিমে বানানোর ফরমাশ নিয়ে এক গিন্নি বান্নি গোছের মা ঠাকরুন গিয়ে পোটোপাড়ায় কথা বলে এসেছেন। তেনার চোখ মুখ রঙের জেল্লাই আলাদা, এ মড়াখেগো রাজ্যের কন্যে বলে পেত্যয় যায় না।
হাড়ি বাড়ির নাতবউদের আর পুজো স্কিপ করা হয়ে ওঠে নি। দেবী মাহাত্ম্য এমন, ভক্তের দান ধ্যানে সে পুজো আজও চলছে হইহই করে। দেবীর ভোগে থোড় তরকারী পাতি এখনও চলে আসছে।
এমন উদাহরণ আছে সিংহালী গ্রামেও। এখানে দেবী দুর্গার নাম বুড়ি মা। গোপভূমের প্রাচীন অমরা গড়ের রাজা তাঁর সিংহ বাহিনী দেবী নিয়ে এখানে বসতি শুরু করেন। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময় পুজো বন্ধ হতে বসছিল যখন দেবী স্বপ্নাদেশ দেন, শুধু থোড় দিয়ে পুজো করো বাপু, তাই বলে পুজো বন্ধ না হয় যেন। থোড় নিবেদন আজও বন্ধ হয়নি। বর্ণহিন্দুর যুদ্ধের দেবী থেকে সাধারণী লোকদেবী হয়ে ওঠার রাস্তায় এমন করেই ভুখা নাঙ্গা মানুষের দুঃখের কথা দেবীর আলতা পায়ের ছাপে লেখা হয়ে গিয়েছে। কবে কোন রাজা কোন ইতিহাস কোন কালিতে লিখবেন, তার দায় লোকদেবীর নিতে ভারি বয়েই গেছে।
সোঞাই গ্রামের বাসুদেব মুখার্জিও এমন ব্যতিক্রম! গরিব ঘরের ঘর জামাই হয়ে সোঞাই গ্রামে শাস্ত্র চর্চা করতেন তিনি। তাঁর দেশের বাড়ি কাটোয়ার কাছে, সেখানে তখন দিব্যি দুর্গাপুজো হয়। সোঞাই গ্রামে পণ্ডিতদের বাস, দুর্গাপুজো করার রেস্তো কারোর নেই। তো ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখে ফেললেন বাসুদেব পণ্ডিত। মহামায়া স্বপ্নে এসে বললেন পুজো করতে, খরচের ভার তিনিই নেবেন। এর পরে পণ্ডিতমশাই আর থাকেন কেমন করে? তিন ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি বাকলসা গ্রাম থেকে দেবীর মূর্তি কাঁধে করে আনতে গেলেন। মূর্তি নিয়ে ফেরার সময় শাহি সড়কে উপস্থিত রাজার কনভয়। বাসুদেব মুখার্জি সাফ জানিয়ে দিলেন মহামায়ার মূর্তি নিয়ে তিনি পাক রাস্তা ছেড়ে অস্থানে কুস্থানে নামবেন না। দুর্গাপুজো বুঝি স্পর্ধার উৎসব? খবর শুনে হাতির হাওদা থেকে নেমে এলেন রাজা কৃষ্ণরাম রায় স্বয়ং। মহামায়ার স্বপ্নের কথা শুনে পুজোর খরচের দায়িত্ব নিলেন, সোঞাই গ্রামের রাজ-সম্পত্তির বড় অংশ দেবত্র করে দিলেন। সময়কাল ১৬৯২ খ্রিস্টাব্দ। এই সোঞাই গ্রামেই আর কয়েক দশক পরেই শাস্ত্র শিক্ষার পথে একদিন ফেমিনিজমের গোড়ার কথা বলতে সতীদাহের সাজানো চিতা থেকে নেমে আসবেন হটী বিদ্যালঙ্কার। খুলবেন প্রথম মহিলা বিদ্যালয়।
মহামায়া কোন রূপে কখন আসেন কে বলতে পারে?
এইবেলা কোদাখাকি দুর্গাদেবীর কথাটা বলে রাখা ভালো। রঘুনাথগঞ্জের বহুরা গ্রামের জমিদার শরৎচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় গভীর জঙ্গল দিয়ে ফেরার সময় একদিন দেখতে পেলেন একদল ডাকাত দুর্গাপুজোর আয়োজন করছে। সেই রাতেই দেবী তাঁকে স্বপ্নে দর্শন দেন আর ওই পুজো তাঁর বাড়িতে করতে নির্দেশ দেন। সেই সঙ্গে, দেবী এও বলে দেন যে, তিনি ওই গ্রামে প্রথম অন্ন গ্রহণ করবেন কোনও মুসলমান পরিবারের থেকেই।
ফ্রয়েড থাকলে এই স্বপ্নের কি অর্থ করতেন সে তর্কে না যাওয়াই ভালো, অর্থম অনর্থম হয়ে যেতে বেশি দেরি হবে না। জমিদার মশাই গ্রামের এক মুসলমান বিধবা নারীকে গিয়ে অনুরোধ করলেন। সেই ভদ্রমহিলা জমিদারবাবুর প্রস্তাব শুনে আঁতকে উঠলেন। তাঁর তো নুন আনতে পান্তা ফোরায়। দুর্গাঠাকুরের ভোগের ব্যবস্থা কি চাট্টিখানি কথা? ও হরি! সেই রাতেই ভদ্রমহিলা স্বপ্নে দেখলেন দেবী বলছেন খুদকুঁড়ো যা হোক নিয়ে এলেই হবে, দেবী ওতেই তুষ্ট। পরের দিন সকাল হতেই জঙ্গলে ছোটেন ভদ্রমহিলা। কোথাও কাউনের চাল হয়েছিল সেই এক মুঠো নিয়ে এসে তা দিয়ে নাড়ু বানিয়ে দেবী দুর্গাকে ভোগ দেন তিনি। কাউনের চালকে 'কোদা' বলা হত। আর সেই কোদা থেকেই এই দেবীর নাম হয় 'কোদাখাকি দুর্গা'।
অনেকে আবার বলেন, এক সময় নাকি ওই গ্রামে ভয়ঙ্কর বন্যা হয়েছিল। সেই সময় দেবী এক মুসলমান পরিবারকে স্বপ্নাদেশ দেন তিনি পুজোয় ভুরুর চালের ভোগ পেতে চান। ভুরুর চালের আরেক নাম হল কাউন। সেই থেকেও কাউনের চাল দিয়ে পুজো দেওয়ার রীতি এখানে বলেই মনে করা হয়। মোটমাট আজও কাউন চালের নাড়ু ভোগ দেওয়া হয় এই পুজোয়। সেই সঙ্গে থাকে, ভাত, সজনেডাটা, কাঁঠাল এবং গঙ্গার ইলিশ। দেবী দুর্গাকে শাঁখা, পলা দিয়ে সাজান এলাকার মুসলমান মহিলারা।
কাঁকুনা গ্রামের খাঁ বাড়ির পুজো আবার অন্য গল্প। প্রাচীন ধনী পরিবার, বৃদ্ধা মা কে বাবার চিতায় তুলে সতীদাহ করে মন্দির বানানো পরম্পরা প্রতিষ্ঠা অনুশাসনের ঐতিহ্য। এনারা সপ্তমী থেকে নবমী টানা বলি দিয়েই ক্ষান্ত হন বা। দশমীর দিন বাগদিদের বাড়ি থেকে চ্যাং মাছ এনে বলি দেবার কড়া নিয়ম। সে বছর, ব্যতিক্রম হলো।
১৯১৩ খ্রিস্টাব্দ, সেপ্টেম্বর মাস। বন্যায় সব ভেসে গেল। বাগদিদের মাথায় হাত। চ্যাং মাছ কোথাও মেলে না। এই বুঝি বাগদি গ্রামের ঘটি বাটি চাঁটি হলো। কি হবে কি হবে আতঙ্কের মধ্যেই ঘট বেলপাতার মধ্যে থেকে লাফাতে লাফাতে উদয় হলো এক চ্যাং মাছ। দেবীর ঘটের মাছকে কি আর কেটে কুটে বলি দেওয়া যায়? সে মাছকে দেবীর প্রতিমার সঙ্গেই জলে ছেড়ে দেওয়া হলো, সঙ্গে দশমীর বলিও বন্ধ হলো। আজ অবধি মহিষাসুরের পেটের ভেতর থেকে বা দেবীঘট থেকে ছাগল বা মোষ বেরোনোর ঘটনা ঘটেনি, তাই এই মর্মে পাঁঠা বা মোষ বলি বন্ধ হতে পারেনি।
প্যারিমোহনের বাড়ির পুজো অবশ্য ছাগবলি বন্ধের জন্যই বিখ্যাত হয়ে আছে। একটা ছাগলছানা বলি দেবার জন্য মণ্ডপে বাঁধা ছিলো। তার ব্যা ব্যা কান্নায় দেবী নাকি ঘুম টুম ভেঙে জেগে যান, তারপর ব্যস্ত হয়ে বলি নিষেধ করে বলেন, তিনি বৈষ্ণব মতের দেবী। বলি তাঁর চলবে না। দেবী এতদিন বলি নিলেন কেন তবে? প্যারীমোহন বিলেত ফেরত হয়ে আসার জন্য অপেক্ষা ছিলো কি? তো যাই হোক, কুমিরকোলার ব্যানার্জিবাড়িতে সেই থেকে ছাগবলির বদলে চালকুমড়ো বলি হয়।
পশুবলির প্রথা এখন কমে এসেছে। অনেক বংশে দীক্ষার কারণে বলির বাজনা শোনাও নিষেধ। ছাগবলি যাও বা হয়, মোষবলি খুব দুর্লভ। নরবলি অবশ্য এখন নিষিদ্ধ। গরিব বাড়ির বারো তেরো বছরের কচি অপাপবিদ্ধ বালক তুলে এনে বলি দেওয়ার প্রথা এখন আর নেই। অনেক বনেদি পুজোয় কাঠির আগায় মন্ড এঁটে সিঁদুর লেপে উচ্ছুগ্যু করা হয় এখনও, তারপরে ছাগ বলি। আবার মানকরের বিখ্যাত চন্দ্রদের বাড়ির নাম হয়েছিল আরেক কারণে। কানাঘুষো বলে প্রাচীন দোতলা বাড়ির দেওয়ালে সোনা গয়না পুঁতে মাঝিদের বাড়ির ছেলেকে জীবন্ত সমাধি দিয়েছিল এই বাড়িতে, যাকে বলে যখ দেওয়া। না, দেবী দুর্গা তার জন্য বিশেষ বিচলিত হয়েছিলেন বলে কোনও জনশ্রুতি নেই। তবে সে বাড়ির কোন বড়গিন্নি এমন সাজগোজ করে ইয়াব্বড় সোনার নথ পরে বসে থাকতেন যে দুর্গা ঠাকুর নাকি রেগে মেগে তাঁকে স্বপ্নে এসে মুখ নাড়া দিয়ে বলেছিলেন অমন ধারা সেজে আমার সামনে এসো না বাছা। লোকে আর আমাকে দেখবে কি? তারা তোমার রূপের গুমর দেখেই চলে যাবে। ভাবুন, মহামায়া বিশ্বেশ্বরী, তিনিও ফেয়ার এন্ড লাভলী কম্পিটিশনে নাকি নেমে পড়েছেন। তা বড়গিন্নি সাবধান হয়ে গিয়েছিলেন। গয়নাগাঁটি পরে প্রতিমার সামনে আর যেতেন না। ধন্য বাঙালি, ধন্য দেবীর মানবায়ন।
ধন্য রসবতীর দুর্গা রসায়নও বটে। তরকারী, মাছ, পশু বলি একরকম। তাই বলে চুনো মাছ দিয়ে কচু বেগুনের ঘ্যাঁট হবে দেবীর প্রসাদ, যা কিনা দুগ্গা চচ্চড়ি বলে নাম করবে? হুগলির রাজবাটির সিংহ বাহিনী দেবী বৈষ্ণবী, বলি নিষেধ, কিন্তু ভোগে দুগ্গা চচ্চড়ি মাস্ট। দেবী যে ঘোর বাঙালি হয়ে উঠেছেন! মাছ ছাড়া তাঁর চলবে কেন?
ফিরব বর্গী আক্রমণের দিনকালে। নবাব আলীবর্দী খাঁ বিপর্যস্ত হয়ে নাকি বিখ্যাত জ্যোতিষ বিশারদ ভাতাড় গ্রামের অযোধ্যারামের কাছে এসে ভাস্কর পণ্ডিতের মেয়াদ জানতে চেয়েছিলেন। কিমাশ্চর্যম্, অযোধ্যারাম বলেছিলেন ভাস্কর পণ্ডিতের মেয়াদ উত্তীর্ণ। এর কিছুদিন পরেই বহরমপুরের কাছে ভাস্কর পণ্ডিত নিহত হয়। আলীবর্দী খাঁ তখন পণ্ডিত অযোধ্যারামের চাহিদামত গ্রামের শ্মশান সংলগ্ন এলাকায় তাঁর কুলদেবী ভদ্রকালীর মন্দিরের ব্যবস্থা করে দেন। দুর্গাপুজোয় ধুমধাম করে তাঁর পুজো হয়। সেই ভাস্কর পণ্ডিতের নবমী পুজো ভাঙার নয় বছরের মাথায় ভাস্কর পণ্ডিতের ইহলীলা সাঙ্গ হলো, সঙ্গে আরেক শক্তিপূজো বিখ্যাত হয়ে উঠল। বৃত্ত বুঝি এইভাবেই সম্পূর্ণ হয়?
সব বৃত্ত সম্পূর্ণই হয়। তবে দুর্বৃত্তের সম্ভোগ আর সাধারণের দুর্ভোগের মধ্যেও লোকদেবী এসে পড়েন কিনা, সেই কাহিনি ছাড়া সাতকাহন অসম্পূর্ণ। রাজা কৃষ্ণরাম রায়ের কথা মনে আছে তো? সেই সোঞাই গ্রামের দুর্গাপুজো স্পনসর করে দেবত্র দান করেছিলেন? তাঁর কন্যা সত্যবতী, অত্যাচারী সুবাদার শোভা সিং আর পেটকাটি দুর্গা বিশালাক্ষীর গুপ্তধনের গল্পের এক আশ্চর্য যোগাযোগ আছে।
সময় ১৬৯৫ খ্রিস্টাব্দ। ঔরংজেবের বিরুদ্ধে স্থানীয় দ্রোহ মাথা চাড়া দিচ্ছে। শোভা সিং ছিল বড় ইজারাদার কৃষ্ণরাম রায়ের অধীনস্থ ছোট ইজারাদার। ওড়িশার আফগান সর্দার রহিম খানের সঙ্গে জোট বেঁধে শোভা সিং সেনাদল তৈরি করল। সম্ভবত সেনাদের মাইনে কম রেখে অবাধ অত্যাচারের একটা সমঝোতা ছিলো, নয়ত মাত্র কয়েক বছরে শোভা সিংহের দল মেয়েধরার জন্য কুখ্যাত হয়ে ওঠে?
কৃষ্ণরাম রায়ের কন্যা সত্যবতী লম্পট শোভা সিংহের বিয়ের প্রস্তাব পায়ে ঠেললেন, কৃষ্ণরাম রায়ের বংশ প্রায় উজাড় হয়ে গেল সেই অপরাধে।
তা সিংহাসনের ইতিহাসে এমন ছোট্ট ঘটনা তো হয়েই থাকে। জনশ্রুতি আছে এক ভদ্রঘরের মা এক গা গয়না পরে তাঁর চার ছেলে মেয়েকে নিয়ে নবমীর দিন পুজো দেখতে যাচ্ছিলেন। শোভা সিংহের দল চড়াও হয়ে সপরিবারে ভদ্রমহিলাকে খুন করে। কিন্তু পেট কেটে ফেলার পরেও দেখা যায় ভদ্রমহিলা দিব্যি হি হি করে হাসছেন। পিলে চমকানো ব্যাপার দেখে দুর্বৃত্তরা মাটিতে সাস্টাঙ্গ হয়। দেবী স্বরূপ ধরে এসে তাদের শিক্ষা দেন, আর সব গয়না খুলে হাঁড়িতে চাপা দিয়ে পাশের পুকুরে ফেলে দেন। ঠাকুর পুকুর আর গুপ্তধনের গল্প আজও পেটকাটি ঠাকুরের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়।
এর পাল্টা জনশ্রুতি বলে দেবী নাকি সন্ধিপুজোর সময় দেখেন বলি টলির ব্যবস্থা কিছুই নেই। সামনে পুরুতের সুন্দরী মেয়ে দীপ জ্বালছে। তাই দেখে দেবী টপ করে কিশোরী মেয়েটিকে খেয়ে ফেলেন। সারা বাড়ি মেয়ের খোঁজ পড়ে একটু পরেই। তন্নতন্ন করে খুঁজে শেষে প্রতিমার সামনে এসে সবার চক্ষুস্থির। দেবীর মুখে ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো কোথা থেকে এলো? ওই ডুরে শাড়ি পরেই তো মেয়েটা দীপ জ্বালতে এসেছিল! শেষে দেবীর পেট কেটে নাকি হারানো মেয়ের সন্ধান মেলে। জীবিত না মৃত? জনশ্রুতি এখানেই থেমে গেছে। আচ্ছা আপনারাই বলুন, আজ অবধি যে মেয়েরা তাদের নাম শুদ্ধু, ছবি শুদ্ধু, মায় খোঁপায় গোঁজা কাঠগোলাপ ফুল শুদ্ধু হারিয়ে গিয়েছে তাদের কজন বেঁচে ফিরতে পেরেছে? এমন নয় তো, পেটকাটি বিশালাক্ষী দেবী দুর্গা মুখে ছেঁড়া শাড়ির টুকরো নিয়ে ডাগর ডাগর চোখে আসলে মনে করিয়ে দিতে আসেন শোভা সিংহের সেনাদল মেয়েদের তুলে নিয়ে যাবার সময় তাদের পরনের কাপড় ছিঁড়ে ফেলে দিত? এমন নয় তো, অসুরদলনী দেবী কাটা পেট নিয়ে আসেন মনে করিয়ে দিতে শোভা সিংহের মত মেয়েখেগো অসুর বধে অনাথ কুমারী রাজকন্যা সত্যবতীই নাকি হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন? এসব কথা পণ্ডিতেরা মানেন না। কিন্তু লোকাচারের মধ্যে দিয়ে যে সালতামামি বোনা হয়ে থাকে তার চেয়ে বড় গুপ্তধন আর কীই বা আছে বলতে পারেন?
গুপ্তধন নয়, দুর্গাপুজো এখন মূলধনের বাজার। ইউনেস্কো হেরিটেজ। পশ্চিমবঙ্গের জিডিপির ৩ শতাংশ আসে এই দুর্গাপুজোর আয়োজন থেকে। হাজার কোটি টাকার লেনদেন চলে পুজোর মরশুমে। একশো দিনের কাজের সন্ধান থাক না থাক, পুজোর খাবার দোকান, মেলা, মন্ডপ তৈরি, আলোর খেলা, বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং লাগানো, প্রতিমা সাজানোর মতন কাজে লেগে পড়েন বহু দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ। মহামায়া রুজি রোজগারের ব্যবস্থা করতে না পারলে আর লোকমাতা হবেন কেমন করে?
শেষ সময়ে টিকিটের অভাবে, ছুটির অভাবে ফেরা হয় না যেসব প্রবাসী চাকুরে বাঙালির, তাঁদের দুর্গাপুজোর সাতকাহন অন্যরকম। দূর দেশে বা কলকাতার অভিজাত আবাসনে নবরাত্রির নিরামিষ লগ্নে পোলাও মাংস খেতে চেয়ে সামাজিক বয়কটের মুখে পড়েন যে বাঙালি, তাঁদের পুজোর গল্পও অন্যরকম। পুজো যার, গল্পেরাও তার।আমরা যারা ভোরের শিউলি কুড়িয়ে পেলে আঁজলা ভরে নিয়ে আসি তাদের গুপ্তধনের সন্ধানও হারানো ক্যাপ পিস্তল, পাখি বেলুন আর শুভ বিজয়া লেখা গ্রিটিংস কার্ডের ভাঁজে রাখা আছে। বাংলাভাষী এলিট প্রবাসী না হয়ে বাংলাভাষী নিম্নবিত্ত পরিযায়ী শ্রমিক বলে বাংলাদেশে পুশ ব্যাক হয়েছেন সোনালি। তিনি তাঁর অনাগত সন্তানের নাম খুঁজছেন বিদেশের জেলে বসে। মহামায়া না কৃষ্ণ, কে আসবেন কারাগারে? আসবেন না কেউ? সোনালির শারদীয়া গল্প এইটুকুই। যার যার গল্প, যার যার যাবতীয় ক্রোধ, রাগ, দুঃখ নিয়ে বাঙালি উৎসবে ফেরে। ফিরতে হয়।
তাহলে আজ এই অবধিই থাক রসমঙ্গল? আমাদের ভোগের থালায় সকলের ভাগ থাক? আমরা মনে রাখি অন্নের সুষম বন্টনেই মঙ্গল।
প্রকৃত রসমঙ্গল।
ধাঁধা
দুর্ যদি হয় তরাস লেগে যায়
দর্শন যদি হয় বিঘ্ন দূরে যায়
জাতি জনতা একত্রে বসে খায়
তথ্যসূত্র
বই
- মহেন্দ্রনাথ দত্ত. পুরাতন কলিকাতার কাহিনি ও প্রথা
- শিবশঙ্কর ঘোষ. বঙ্গের শারদোৎসব ও ব্যতিক্রমী দুর্গাপূজা
প্রবন্ধ
- মায়ের পায়ে শিকল, মুখে আঁচল, পেট কাটা, ৪১৯ বছর ধরে এই রূপেই গদাইপুরে পূজিতা দেবী. আনন্দবাজার
- অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী. এ এক অন্য দুর্গার গল্প! মুসলমান পরিবারের ভোগ ছাড়া পুজোই নেন না দেবী 'কোদাখাকি'. টাইমস নাউ
- শোভা সিংহ. বাংলাপিডিয়া
- সঞ্চারি ভৌমিক. মৃৎশিল্পীর ভুলে দেবী হয়ে গেলেন নীল, কৃষ্ণনগরের দুর্গাপুজোর ইতিহাস আজও বিস্ময় জাগায়. Inscript