ভাষ্য
উছলি উছলি চলে চঞ্চল চপল চটুল চমকি চমকি
তরঙ্গ ভঙ্গে বিভঙ্গে অতিরঙ্গে অঙ্গে জলধি ভাঙ্গে ছলকি ছলকি
গজদন্ত দ্রুধরত্ন রাধা-কজ্জ্বল শ্যাম হরিদ্র লহু সুবর্ণ শান্ত উগ্র
কত আকার প্রকার নানা রূপ তার অতি প্রকান্ড অণু ক্ষুদ্র
রূপেতে রঙেতে অযুতে নিযুতে যুথে যুথে কত শত যুগ ধরে
নদীতে সলিলে খুঁজি, খুঁজি আলে খালে বিলে পুকুরে দীঘিতে সরোবরে
নিয়ে বঁড়শি বুচনা বানা ঝাঁকি ছাঁকি খড়া টানা জাল ছিপ খালুই পলুই
.... বল দেখি কার কথা কই?
মাছ মৎস মীন!
আমরা ভাজা মাছ উল্টে খাওয়ার আর্ট জানি। তাই বলে যার নাম মাছভাজা তাকেই কি আমরা চিনি ফিশফ্রাই বলে?
নামেই মালুম, একটি দিশী আরেকটি নিখাদ বিদেশী কেতা। মাছ ব্যাপারটা গঙ্গাহৃদির একেবারে হৃদয়ের কাছে। প্রাকৃত কবিবর বলছেন,
ওগগোর ভততা রম্ভঅ পত্তা
গায়েক ঘিততা দুগ্ধ সজুত্তা
মোইনি মচ্ছা নালিচ গচ্ছা
দিজ্জই কন্তা খাই পুণবন্তা
কলাপাতায় গরম গরম ভাত, গাওয়া ঘি, পাট শাক, মৌরলা মাছ, আবার দুধ। সব রেঁধে বেড়ে খেতে দিয়েছেন কান্তা,পুণ্যবান ভোজনে বসেছেন। তিনি কি শাক দিয়ে মাছ ডাকছেন? শাক আর মাছের যুগলবন্দী তো আজকের নয়? রুই মাছ দিয়ে কলমীর আগা, গিমেশাক দিয়ে মাগুর ঝোল - এইসব ডেলিকেসি বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গলে ভুরি ভুরি ছড়ানো। মাছে মাছে যাকে বলে মৎস্য মঙ্গল।
কটু তেলে রান্ধে বামা চিতলের কোল।
রুহিতে কুমুড়া বড়ি আলু দিয়া ঝোল।।
কটু তেলে কই মৎস্য ভাজে গণ্ডা দশ।
মুঠি নিঙারিয়া তথি দিলা আদারস।।
শাস্ত্রে বলেছে কুমড়ো বড়ি সহযোগে নাকি মাছের ঝোল নিরামিষ হয়ে যায়। বৃহদ্ধর্মপুরান আরও এক কাঠি এগিয়ে। সেখানে বলছে ইলিশ, খলিশ, ভেটকি, মাগুর আর রুই হলো গিয়ে নিরামিষ।
ইলিশ খলিশ্চৈব ভেটকি মদগুরেন এব চ
রোহিতো মৎস্য রাজেন্দ্র পঞ্চমৎস্য নিরামিষাঃ
ভাবুন একবার! সত্যিই তো, মাছ ছাড়া বাঙালির শুভ কাজ অসমাপ্ত। বেহুলা লখিন্দরের মেগা বিয়ে এপিসোড, তার তারকা মেনু শুনুন।
ভাজিয়া তুলিল কথ চিথলের কোল
মাগুর মৎস দিয়া রাঁধে মরিচের ঝোল
কৈ মৎস তলিত করিলো বিস্তর
মহাশোল দিয়া পাছে রান্ধিল অম্বল
মহাতৈল দিয়া ইচার রসলাস
দেড় যোজন যায় ব্যঞ্জনের বাস
রুহিতের মুণ্ডা দিয়া মাস ডাল করি
রান্ধিল মরিচ তবে তারকা সুন্দরী
বিয়ে হোক বা অন্নপ্রাশন, পেট ভরে ঝোল ভাত খাওয়ানোর রেওয়াজ সেই থেকেই গিয়েছে। কয়েক দশক আগেও উচ্চবর্ণের হিন্দু বিধবাদের মাছ খাওয়া একটা বড় ট্যাবু ছিলো, ঠিক যেমন সম্পত্তির ভাগে মেয়েদের ছিলো বিষম অধিকার। ধীরে ধীরে মাছ ভাত জমির অধিকার ফিরছে মেয়েদের হাতে, মাছের পিঠে চেপে এও আরেক রকম শুভ কাজ বই কি!
শাস্ত্র যাই নিদান দিক, বিলিতি বণিকরা এত রকম নোনা মিষ্টি জলের মাছ চোখের সামনে দেখে ভেবলে যাবে না তেমন তো শাস্ত্রে কোথাও লেখা নেই। বিলিতি জিভ আবার কাঁটা বাছতে কাতর।
তখনও বাসার প্রতি ভালোবাসা জন্মায়নি এই বঙ্গে, তাই বলে ভেটকির ফিলে করে বিস্কুটের গুঁড়ো আর ডিমের গোলায় চুবিয়ে কখনও এমনি ফ্রাই, কখনও কভারেজ ফ্রাই, কখনও কিশমিশ আলুসেদ্ধ মিশিয়ে মাছের চপ, আঁশটে গন্ধ থেকে সাহেবসুবোরাও নিজেদের বঞ্চিত রাখেননি। বাজারে তখনও ফেলুদা আসতে শয়ে শয়ে বছর দেরী, তোপসে সুপারহিট হয়ে গেল। গল্পে সিনেমায় নয়, ডিনার টেবিলে। ব্যাটার ফ্রাই হয়ে তোপসে মাছ সিধে বিলিতি পার্টিতে হাজির। সাহেববিবিরা যাকে আদর করে বলতেন ম্যাঙ্গো ফিশ। নরম কাঁটার মাছ হিসেবে লোটে, কাচকি, মৌরলাও ব্যাটার ফ্রাই, পেঁয়াজি হয়েছে। হাত হোক কি কাঁটা চামচ, উঠবে তো সেই মাছই।
এর পর উপনিবেশ স্বাধীন হবার প্ল্যাটিনাম জুবিলি পেরিয়ে গেলেও ফিশফ্রাই ফিশফিঙ্গারের মতন বিলিতি মাছভাজা বাঙালি রসনা থেকে উৎখাত করা যায়নি। পালা থেকে মেলা, এমনকি বইমেলাতেও, কোন দোকানে সবসময় উপচে পড়ে ভিড় তা আমরা সবাই জানি।
এই, দূর দুরান্ত থেকে মেলা দেখতে এসে মাইল মাইল হেঁটে খিদে পায় না? মনটা একটু মাছ মাছ করে না? খিদে বড় বালাই, সে আমরা মানি না মানি। আর মাছ? মাছ হলো ইমোশন।
এই যেমন ধরুন পাঁচ দশক আগেও, গৃহস্থ বাড়ির জন্য খিড়কি পুকুর একটা শ্বাস প্রশ্বাসের মতন অভ্যাস ছিলো। সেই পুকুরে রুই কাতলা শোল মাগুর পাওয়াই যেত, তার জন্য ভেড়ি ফেঁদে বসার প্রয়োজন হত না। তা গরম পড়ার আগে আগে চোত বোশেখের দুপুরে বাড়ির যিনি সর্বময়ী কত্রী, তিনি একটা খালি কলসি আনতেন, মাটির। শীতকালের ওই গুড়ের কলসী হত না? অবশ্যই ফাঁকা। তারপর সে কলসির তলায় ফুটো করে এক ডুবে পৌঁছে যেতেন পুকুরের তলায়, কলসীটা কায়দা করে উল্টে কাদায় বসিয়ে দিয়ে উঠে আসতেন। পুকুর থেকে উঠে একটা পান মুখে দিয়ে কনিষ্ঠ কন্যাকে বলতেন, “মনি, দিন কুড়ি পরে মনে করাস”। মনির তো কুড়ি দিন কাটত কুড়ি বছরের উত্তেজনা নিয়ে। তারপর ঠিক ঠিক সময় হলে গৃহিণী ফের নামতেন পুকুরে। এক ডুবে কলসী তুলে একহাতে চাপা দিয়ে উঠে আসতেন পাড়ে। দৌড়ে আসত মনি, ফার্স্ট লুকের অধিকার তার একার। কলসি খুলতেই, ও মা! খলবল করছে রুপো রুপো রুপো! খোলসে, কুচো চিংড়ি,পুঁটি, বাঁশপাতা এ যে নানানি বিমুনি মাছ!
মনির মাছ গুনতে গুনতে কড়ায় তেল গরম হয়ে গেল, নুন হলুদ দিয়ে ভাজা হতে হতেও গোনা শেষ হলো না।
আজ চৌখুপি এপার্টমেন্টের মডিউলার কিচেনে মাছ ধুতে ধুতে মনিদের মনে পড়ে যেতেই পারে সেসব গুপ্তধনের কথা।মনে পড়ে যেতেই পারে ইলিশ চিতল বহুমূল্য তা কেনা যায়। যা অমূল্য তা বাজারে মেলে না।
এইজন্যই বলি মাছ হলো গভীর দর্শন। নইলে ভাবুন, প্রাণের ঠাকুর রবি ঠাকুর ভাবের সমুদ্রে থাকবেন সেটাই স্বাভাবিক, কিন্তু ভাবের সরোবরে মাছ ধরবেন সেটা কি সহজে ভাবা যায়? তিনি লিখছেন,
ভাবের সরোবরে আমরা জাল ফেলিয়া মাছ ধরিতে পারি না; ছিপ ফেলিয়া ধরিতে হয়। আমরা পরের মনঃসরোবর হইতেও মাছ তুলিয়া থাকি। আমার এক সহচর আছেন, তাঁহার পুষ্করিণী আছে কিন্তু ছিপ নাই। অবসরমত আমি তাঁহার মন হইতে মাছ ধরিয়া থাকি, খ্যাতিটা আমার। নানা প্রকার কথোপকথনের চার ফেলিয়া তাঁহার মাছগুলাকে আকর্ষণ করিয়া আনি ও খেলাইয়া খেলাইয়া জমিতে তুলি।
রবিবাবুর পেটে পেটে যে এত কে জানত বলুন? কবি সাহিত্যিকজনেদের মাছ নিয়ে বিশ্বাস নেই। কখন কি করে ফেলবেন আঁচ করা কঠিন।
কবি নির্মলেন্দু গুণের গল্পটা যেমন। কবি তখন তরুণ। রাতের ঢাকায় বোধ হয় শহর মাপতে বেরিয়েছিলেন। গভীর রাতে পুলিশের খপ্পরে পড়লেন। অফিসার তো থানায় চালান দেবেনই দেবেন। কবি বললেন, আমায় নিয়ে কেন টানাটানি করছেন। আমি এক নিরীহ কবি। শান্তিরক্ষক এত সহজে মানতে নারাজ। জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কবি তার প্রমাণ কী? নির্মলেন্দু গুণ এক মুহূর্ত দেরী না করে দুলাইন শুনিয়ে দিলেন- মাছের রাজা ইলিশ, মানুষের রাজা পুলিশ। ব্যস আর যায় কোথায়, পুলিশ তো ডগমগ খুশি। ইলিশের কল্যাণে কবি ছাড়া পেলেন। তা কবি তো ছাড়া পেলেন, কিন্তু এই ছড়ার কপিরাইট কার? সময় তখন সাতের দশক, সময় তখন বারুদ। লালবাজার থেকে ব্যারাকপুর, কলকাতা শহরে মফস্বলে আনাচে কানাচে অনেক ফিসফাস গুঞ্জন ঘুরত, এই ছড়া তার একটি তো বটেই। ছড়াকার কে কেউ জানল না, ইলিশ আর পুলিশ থেকে গেলেন।
পুলিশের কথাই যখন উঠল বলি, থানার নাম হলো শ্বশুরঘর, কারণ বাঙালি বড় রসিক। তাই বলে ইলিশ হলো জামাই? সে কেমন গল্প বটে?
গল্প হলেও সত্যি। বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জের কুড়িখাই গ্রাম। সেখাঁনে প্রতি পৌষ সংক্রান্তিতে মেলা বসে। সাধক শাহ শামসুদ্দিন বুখারির মাজারে ওরস উপলক্ষে। কিসের মেলা?
মাছের। নানা প্রজাতির মাছ আসে মেলায়। কোনো কোনো মাছ দেড় থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত দামেও বিক্রি হয়।
এই মাজারের বয়স নয় নয় করে আটশ বছর তো হবেই। মেলার ইতিহাসও বহু প্রাচীন। লোকের বিশ্বাস কুড়িখাই মেলার মাছ খেলে মুসিব্বত কেটে যায়।আশপাশের গ্রামে ঝেঁটিয়ে লোক আসেন, জামাই নিয়ে। সেটাই রেওয়াজ। এই মেলার তাই স্পেশাল নাম ‘জামাই মেলা’।
আর মেলা থেকে কিনে আনা মাছ হলো ‘জামাই মাছ’। বলাই বাহুল্য জামাই রাজা বলতে মাছের রাজা ইলিশকেই কবি বোঝাতে চেয়েছেন। এই হলো জামাই ইলিশের গল্প।
গল্পকথাই বটে। এই যেমন গাংধাড়া, কাজলি, রীঠে, খোলসে, বোরোলি, রাসভোরা , দাঁড়কে , বট কই, ফলুই, শরপুঁটি , কাঞ্চন পুঁটি, মেদি, ধানিয়া, ক্যাকচেরা, ক্যাচকেচি, চাপিলা, বৈচা, চাটুয়া, নাপতানি, গুলশা, বাইলা, টাকি, চেলি, মলা, ঢেলা, কানপোনা, ডানকিনা, বাচা, পিয়ালি, জয়া, চ্যাং, ফুলচিংড়ি, বাতাশি, কাকিয়া, কুচিয়া, তারা, খোকসা, খড়কুটি, দেশি জাতের পটকা, কাশ খররা, টাটকিনি - এরা এখন গল্পের মাছ। ভেড়ির গ্ল্যামারাস মাছের কৌলিন্য না থাকায় বহুকষ্টে কদাচিৎ এদের দেখা মেলে। গবেষকরা হিসেব করে দেখেছেন, বাংলার মিষ্টি জলে কম বেশি ১৪৩ রকমের ছোট মাছ পাওয়া যেত। যার মধ্যে ৬৩ রকমের ছোট মাছ বাঙালির পাত থেকে একেবারেই হারিয়ে গেছে। যা আছে সে শুধু গল্পে কবিতায়।
মঙ্গল কবি গাইছেন,
বদরি শকুল মীন রসাল মুশুরি।
পণ চারি ভাজে বামা সরল-সফরি।!
বদরি শকুল, মানে কুল দিয়ে শোল। তাই দিয়ে হবে খাসা অম্বল!
সফরি হলো পুঁটি! আর কি কি আছে মেনুতে শুনি?
ইলিশ তলিত করে, বাচা ও ভাঙ্গনা।
শউলের খণ্ড ভাজে আর শউল পোনা
বড় বড় ইচা মৎস্য করিল তলিত।
রিঠা পুঠা ভাজিলেক তৈলের সহিত
রুই কাতলার তৈলে রান্ধে তৈল শাক
মাছের ডিমের বড়া মৃতে দেয় ডাক
এই এতক্ষণে ফিল্ডে নামলেন শ্রীমান মোহনবাগান। ইলিশ নিয়ে ইস্ট বেঙ্গলের একাধিপত্য থাকবে, যেমন ইচা, মানে চিংড়ি থাকবে মোহন বাগানের। বড় বাগদা গলদা হলে তবেই না থাকে মোহন বাগানের মান! মঙ্গলকাব্যে ফুটবলের কথা লেখা নেই যদিও। লেখা আছে
রিঠা মাছ, আর রুই কাতলার ডিমের বড়া, তেল চচ্চড়ি, মাছের তেল দিয়ে শাকের ঘন্ট - এইসব সুখাদ্যের অমৃত উপাখ্যান।
তা কবিদের কথাই যখন হচ্ছে, সব মাছের কি কবিতায় সাহিত্যে সমান অধিকার?
বিজয়গুপ্ত সেকালে বসে ইলিশ আর বাচা বিভেদ নাই করতে পারেন, কিন্তু পোস্ট মডার্ন যুগে ইলিশ চিতল ছাড়া স্ট্যাটাস থাকে না, এও সত্যি। কবি তসলিমা নাসরিন বলেছিলেন একটা কবিতায় মাগুর মাছের নাম করেছেন বলে অন্য কবিরা নাক সিটকেছেন। তাতে অবশ্য তিনি মাগুরের পক্ষ ছাড়েননি।
বিজয়গুপ্ত একালে মঙ্গলকাব্য লিখলে কী পেতেন? বিতর্ক ছাড়া আদৌ কিছু পেতেন?
বিতর্ক থাক, বরং মাছে ফেরা যাক? সাতাশ হাজার রকম মাছ হয় এই জলপৃথিবীতে, অন্তত পনের হাজার এমন মাছ আছে যার নামকরণ হয়নি এখনও।
সে নাই হলো, তা আমরা রেসিপি নিয়ে কিছু বলব না?
মাছ খিদে পাচ্ছে তো। মাছের কোনও রেয়ার এন্ড লস্ট রেসিপি নেই?
দাদন আছে। না, নীলের দাদন নয়, জলপাই দাদন। বহু পুরনো রেসিপি। শোল বা রুই ছাড়া অন্য মাছ বারণ। মাছের তেলের জায়গাটা এড়িয়ে যেতে হবে।
খুব ডায়েট ফ্রেন্ডলি নয় তাই বলে। এক কিলো মাছে তেল লাগবে দেড় লিটার।আচ্ছা থাক, ডায়েটের কথা না ওঠাই ভালো। আর উপকরণ?
মাছ যতটা তার ডবল জলপাই লাগবে। এখন যদি আপনার সুকুমার রসবতী বলে
“মশাই এ তো জলপাইয়ের সময় নয়, কাঁচা আম চান দিতে পারি।”
তাহলে?
জলপাই না পেলে কাঁচা আম ও চলবে।মাছ ভালো করে ছাল ছাড়িয়ে সেদ্ধ করে নিতে হবে। তারপর ঠান্ডা করে চেপে জল বার করে কাঁটা বেছে নেবেন। এই মওকায় জলপাই সেদ্ধ করে বীজ ছাড়িয়ে মাছের সঙ্গে মিশিয়ে নিন। সঙ্গে নুন হলুদ মাস্ট। এবার তেল অর্ধেক গরম করে সর্ষে ফোড়ন দিন, মাছ আর জলপাই মাখা ওতে দিয়ে কষুন।
আর বাকি তেলটা? তেলা মাথায় ঢালব? নাহ। মাছমাখা কষাতে গিয়ে বাকি তেলটা দিয়ে দিন। জল শুকিয়ে এলে রাঁধুনি বাটা দিয়ে নেড়ে চেড়ে নামিয়ে নিতে হবে।জলপাই দাদন তৈরি।
এসব রাঁধবেন যখন ভুলেও ডায়েটেশিয়ানকে জানাবেন না। আচ্ছা মাছ দিয়ে কতরকম রান্না হয় বলুন তো?
মাছের পদ আর ইলিশ মাছের কাঁটা একই বস্তু। যতই গোনো শেষ নাহি যে। তা ফ্রায়েড ফিশ দিয়ে শুরু করেছিলাম। ড্রায়েড ফিশ নিয়ে শেষ না করলে মাছের তেলে মাছ ভাজা হয়ে উঠবে না।
ড্রায়েড ফিশ, অর্থাৎ শুঁটকি মাছ। মেছো বাঙালির রসনায় হয় প্রেম নয় ঘৃণা। রসনার বাইনারিতে শুঁটকি হল একমেবাদ্বিতীয়ম। এই পৃথিবীতে খিদের একটা হায়ারার্কি আছে, সে সকলে জানে। চামড়ার রং, ধর্ম, জাত, দেশ, অক্ষাংশ, দ্রাঘিমা, লিঙ্গ পরিচয়, বৈবাহিক সম্পর্ক ঠিক করে দেয় কারা খেতে পাবেন, কারা আগে খাবেন, বেশি খাবার হক কাদের। আর না খাবার বিধান কাদের জন্য।
এই যে, মাহি কাবাব, ফিশ এন্ড চিপস ছাড়া মোগলাই, কন্টিনেন্টাল কিচ্ছু চলে না। সুশি সাসামী তো পাঁচতারা হোটেলের মেনুতে মহার্ঘ্য বস্তু। আবার এই দেশেই এমন অনেক নিরামিশাষী শহর আছে, যেখানে বাড়িতে মাছ রান্নাই নিষিদ্ধ। বাঙালিরা প্রবাসে গিয়ে বাড়ি ভাড়া পান নি, মাছখেকো অভ্যেসের জন্য, এমন ঘটনাও বিরল নয়।আর এই বাংলায় আমরা মাছ ছাড়া কিছু বুঝি না যারা, তারাও অনেকে উল্টোদিকের বাড়িতে শুঁটকি রান্না হচ্ছে টের পেলে দু কথা শুনিয়ে আসি, তাই না?
শুঁটকি। অসমে যাকে বলে লাসিম, ওড়িশায় শুখুয়া। চ্যাপালু বলে অন্ধ্রে, কারুভাডু হলো কেরল, তামিলনাডুতে। মহারাষ্ট্রে সুকাট মাচ্ছি। এই ভারতের উপকূল বরাবর বিরাট সংখ্যক মানুষের ভালোবাসার খাদ্য, শুঁটকি মাছ। বিভিন্ন ধরনের মাছ শুকনো করে প্রিজার্ভ করার এই পদ্ধতি কবে থেকে চালু হয়েছে, কে চালু করেছে, কেউ জানে না। শুধু নদী সুস্বাদু মাছ জোগান দিয়ে গেছে - লটে, ইলিশ, চিংড়ি, পুঁটি, কাজলি। আর ক্ষুধার্ত মানুষ যাদের খিদে পেলেই খেমো মাছের টুকরোর রাই ঝোল, মরিচ ঝাল করার সামর্থ্য নেই? তারা মাছ বেশি পেলে বসে বসে মাছের পেট থেকে নাড়ি ভুড়ি জল বার করে নুন দিয়ে রোদে শুকিয়ে নিত। তারপরে নিয়ম মেনে রাখলে ও মাছ টিকে যেত অন্তত দুটো বর্ষা।
জলের দেশের মানুষদের বুদ্ধিই আলাদা তাই না? জলের দেশে রসনার খবর চাপা থাকে না। স্বাদের আহ্লাদ বয়ে যায় কুঁড়ে ঘর থেকে প্রাসাদে। অচিরেই নদীমাতৃক বাংলায়, বিশেষত বন্যাপ্রবণ বাংলায় শুঁটকি হয়ে উঠল এক ডেলিকেসি।তারপর? পূর্ব বাংলা থেকে উদ্বাস্তু হয়ে এসে কোটি কোটি বাঙালি নতুন করে শিকড় গাঁথলেন এপারে। নদী, খাল, বিল, আচার, বিচার সমেত পুরো শিকড়ের মায়া রয়ে গেল র্যাডক্লিফ লাইনের ওপারে। রিফিউজি কলোনীর বাসায় শুঁটকি রান্না করতে গিয়ে অনভ্যস্ত প্রতিবেশীদের থেকে গালমন্দ খাওয়া - সেও আরেক রকম শিকড় গেড়ে দেয়। খিদের হায়ারার্কি বুঝে নেওয়ার এক্সপেরিয়েন্স স্মৃতি হয়ে থেকে যায় নতুন শিকড়ে। তিন প্রজন্ম পরেও আজ বন্ধু বান্ধব নিয়ে টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরির ফাইন ডাইনিংয়ে খেতে গিয়ে শুঁটকি অর্ডার করার সময় চোরা ভয় কাজ করে, কেউ কিছু মাইন্ড করবে না তো? সুশি সাসামী এলিট, শুঁটকি নিম্নবিত্ত। ওই, যেভাবে সম্পূর্ণ হয় সকল বৃত্ত।
তবে কি শুঁটকি কেবল ওপার বাঙালির?
ইতিহাস সাক্ষী আছে, লীলা মজুমদার বলছেন
“আমাদের দেখেই দিনদা বললেন তেজ তোদের জন্য একটা আশ্চর্য জিনিস রাঁধছে।
রান্নাঘরের কাছে গিয়ে দুর্গন্ধে টিঁকতে পারি না।
মাগো, তেজুবাবু শুঁটকি রাঁধছেন। যদ্দুর মনে পড়ে উনি শ্রীহট্টের ছেলে। আমাদের প্রতিক্রিয়া দেখে দিনদা চটে কাঁই। ভালো জিনিস ভালো লাগবে কেন? রাঁধলে মোটেই গন্ধ থাকে না। ইত্যাদি কত কী বললেন! খেতে বসে আমরা শুঁটকি মাছ ভাত চাপা দিয়ে লুকোই, আর দিনদা নিজে পায়েস খাবার পরেও আর এক গ্রাস শুঁটকি খেয়ে মুখশুদ্ধি করলেন।”
রবীন্দ্রনাথের অগ্রজ দ্বিজেন্দ্রনাথের পৌত্র দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সবার দিনু ঠাকুর, লীলা মজুমদারের দিনদা। এপারের জোড়াসাঁকোর বাসায় জন্মে ওপারের শুঁটকিকে মন দিয়েছিলেন। এমন দলছুট রোমান্টিক বলেই হয়তো তাঁর দেওয়া সুর এত রোমান্টিক?
ভালোবাসি, ভালোবাসি, মাছ খেতে আমরা ভালোই বাসি।
তাহলে আজ এই অবধিই থাক রসমঙ্গল? আমাদের ভাতের পাতে একটু আঁশ থাক, এটুকুই আশ। আমরা মনে রাখি অন্নের সুষম বন্টনেই মঙ্গল।
প্রকৃত রসমঙ্গল।
ধাঁধা
পাখি নও কিন্তু ধর মনোহর পাখা।
সুমধুর মিষ্ট রস সব-অঙ্গে মাখা॥
একবার রসনায় যে পেয়েছে তার।
আর কিছু মুখে নাহি ভালো লাগে তার॥
কৃতজ্ঞতা
রোমেল রহমান
তথ্যসূত্র
বই
- মুকুন্দরাম. চন্ডীমঙ্গল
- রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র. অন্নদামঙ্গল
- বিজয়গুপ্ত. মনসামঙ্গল
- দ্বিজ বংশীদাস. মনসামঙ্গল
প্রবন্ধ
- টি আজিজ. মেলা থেকে মাছ নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার রীতি যেখানে. 2025-02-15
- আদার ব্যাপারী. জামাই মেলা: গাজীপুরের ঐতিহ্যবাহী উৎসব. 2025-01-15
- এম রাশেদুল হক. গোয়ালন্দে পদ্মার ইলিশ এখন সোনালি অতীত. 2022-08-24
- শামিম আহমেদ. পায়েসের পর শুঁটকি দিয়ে মুখশুদ্ধি করতেন দিনু ঠাকুর!. 2020-07-10