ভাষ্য
কার্তিকী অমাবস্যা বড় ধুমধাম
চতুর্দশীতে লই পূর্বনারীর নাম।
অমানিশা তিথি অযোধ্যা পুণ্য ধাম
চোদ্দ বছর পরে ফেরেন সিয়া রাম।
দীপাবলির আলোকে জাগে দশ দিক।
কোজাগর আশ্বিনের পর দীপান্বিতা কার্তিক।
ক্ষেত জাগে, খনি জাগে, যতেক কুলি কামিন
জেগে আছে সুখী দুঃখী সকল ভক্তজন।
হিমালয় রোষে ওঠে, জগত কাতর
ভরা নদী কূল ছাপে আশ্বিন ভাদর।
মানুষের লোভে আজ মানুষেরে হানে
এসো মাগো ত্বরা করি বাংলার থানে।
লক্ষ্মী বলে ডাকি যারে করি তারে হেলা
শস্য ধান্য আজ বিষে ধন্য হই গেলা।
অলক্ষ্মী বলে যারে দিলা নির্বাসন
সেই বুঝি করিত এই গরল নিবারণ।
ভারত পড়িব আর ধরিব রামায়ণ।
বহুকালের ইতিকথা করিব বর্ণন।
ভানু মতি ভনে শোনো অদ্ভুত এই কথা
লক্ষ্মী অলক্ষ্মীর এই আশ্চর্য গাথা।
দীপান্বিতা লক্ষ্মী নারায়ণের পুজোর আগে করতে হয় অলক্ষ্মীর পুজো। গত এপিসোডে আমরা দেখেছি এই অলক্ষ্মীর সঙ্গে বাংলার প্রাচীন শস্য ও প্রজননের দেবীর আশ্চর্য মিল। আজ আমরা আলোচনা করব এই লক্ষ্মী অলক্ষ্মী ভেদের গোড়ার কথা, বুঝে নেব দেবী বদলে যাবার কারণ ও ধরন। আসলে কৃষি আর প্রজননের সম্পর্ক ততটাই আদিম যতটা মানুষের সার্ভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট হবার দায়। মাতৃপূজক হরপ্পায় নইলে দেবীমূর্তির যোনিদেশ থেকে পল্লবিত শস্যচারা দেখতে পেতাম আমরা? লোকস্মৃতি যতদূর যায় তারও ঢের আগের যুগ থেকে ধরিত্রীকে দেবীজ্ঞানে পুজো করেছে মানুষ। দেবী কেন?
জন্মরহস্য জানা আছে বলেই মেয়েরা হয়েছে দেবী। আগে তাদের পুজো, তবেই না সৃষ্টি বাঁচে?হরপ্পা মহেঞ্জোদাড়ো সভ্যতা বাঁচেনি। ব্রোঞ্জ যুগ শেষ হয়ে লৌহ যুগে মিলেছে। আর দেবী? শস্য যতদিন, কৃষি যতদিন, ফসলের প্রার্থনাও ততদিন। গুপ্ত যুগে তৈরী হয়েছে লজ্জাগৌরী।
‘লজ্জা’ কথাটি খেয়াল করতে হবে, এই সব কীওয়ার্ড মানেই ঐ আসে পিতৃতন্ত্র অতি ভৈরব হরষে, তো সেখানেও গৌরীমূর্তি মলাসনে বসে আছেন, তাঁর যোনিদেশ অলংকার সজ্জিত হয়েও দৃশ্যমান, মাথার স্থানে ঘন কমললতা শোভা পাচ্ছে। কোথাও তিনি অদিতি উত্থানপদ, কোথাও নগ্ন কবন্ধ। দু হাজার বছর আগে সৌভাগ্যলক্ষ্মী, সন্তানলক্ষ্মী এবং ধনলক্ষ্মীর এই রূপ দাক্ষিণাত্য থেকে প্রাগজ্যোতিষ থেকে সৌরাষ্ট্র অবধি পূজিতা হতেন, হয় টেরাকোটা নয় পাথরের মূর্তিতে। আবার ইলোরার গজলক্ষ্মী বৌদ্ধ বসুধারার প্রতীক হয়ে আছেন। ধরিত্রী, প্রজনন, সৌভাগ্য এক সূত্রে গাঁথা।
দিনকাল পাল্টে গিয়েছে। জন্মরহস্য এখন আর তেমন গূঢ় তত্ত্ব নয়। বরং জন্ম নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দেশে দেশে প্রবল দুশ্চিন্তা। লোক বেশি, কিন্তু বড়লোক খুব কম। আবার উচ্চকোটির ধনপতিদের ঘরে লক্ষ্মীর এমনই দয়া যে দুনিয়ার বেশির ভাগ ধন সম্পত্তিই তাঁদের দখলে। অনেকটা জগৎ শেঠের মতন আর কি! সে গল্প তো সোজা লক্ষ্মীর পাঁচালীতে জায়গা করে নিয়েছে। মোটমাট ব্রোঞ্জ যুগের মতন এখন আর মেয়েদের কেবল সন্তান পয়দা করার উপায় না ভাবলেও চলবে। যদিও তাতে মা হতে না পারলে বা না চাইলে মেয়েদের সৃষ্টিছাড়া অলক্ষ্মী ভূষণ এখনও সহজেই জুটে যায়। মনে রাখতে হবে দেবীর পুজোর উপাচারে ঘট, শীষযুক্ত ডাব জোগাড় করতেই হয়, যা কিনা সবই নারীর সন্তান ধারণের আধার জরায়ুর রূপক।
মেয়েরা মা হতে না চাইলে সমাজের জন্য এখনও লক্ষ্মীছাড়া ঘটনা সে তো আমরা জানি। মাতৃরূপে দেবীপূজার আদিম সংস্কারের মধ্যেই পিতৃতন্ত্র যখন জাঁকিয়ে বসে তখন মেয়েদের চাওয়া না চাওয়ার অধিকার বস্তুটা শ্রয়ডিঙ্গারের বেড়ালের মতন আছে অথচ নেই হয়ে যায়। কোয়ান্টাম ফিজিক্সের নোবেল লরিয়েটও সে সমস্যার সমাধান পাবেন কিনা বলা খুব মুশকিল।
মুশকিল জীবন। তাহলে বরং ওই জগৎ শেঠের গল্পটাই একবার শুনে নিই?
প্রথমেই ডিসক্লেমার দিয়ে রাখি, এই গল্পের কোনও ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। জগৎ শেঠের বাবা মানিক চাঁদ, যিনি কিনা দিল্লির বাদশাহের থেকে ব্যাঙ্কিং করার লাইসেন্স সুবাদে শেঠ উপাধি পেয়েছিলেন তাঁর মেধার গুণগানও কিছু নেই। গল্প লক্ষ্মী ছেলে জগৎ আর তার মা পদ্মাবতীকে নিয়ে। জগৎ শেঠ ভালো ছেলে হবার কম্পিটিশনে ফার্স্ট হয়ে দিল্লির বাদশাহের থেকে প্রাইজ পাচ্ছিলেন। পদ্মাবতী ছেলেকে বুদ্ধি দিলেন, যে প্রাইজ হিসেবে সাল দোশালা উপহার নয়, জগৎ যেন আবেদন করে সামনের পূর্ণিমায় সব গেরস্থ ঘরে আলো নেভানো থাকবে। ভালো ছেলেরা বেশি প্রশ্ন করে না। জগৎ তাই বাধ্য ছেলের মতন বাদশাহকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন সামনের পূর্ণিমায় দেশে যেন সবাই রাত্তিরে আলো নিভিয়ে রাখে। বাদশাহ একটু অবাক হলেন, কিন্তু অনুরোধটা ফেললেন না। আর তারপর? কী হলো আশ্বিন পূর্ণিমায়?
এবে মর্ত্যে লক্ষ্মীদেবী দিল দরশন।
প্রতি গৃহে গৃহে তিনি করেন ভ্রমণ॥
দেখিলেন সব গেহ অন্ধকারময়।
আলো মাত্র জ্বলিতেছে জগৎ আলয় ॥
দ্রুতগতি গিয়া তথা করেন প্রবেশ ।
দেখিলেন সিংহাসন সাজায়েছে বেশ ॥
হৃষ্টমনে লক্ষ্মীদেবী তথা দাঁড়াইল
হেরিয়া বিশুদ্ধ গৃহ সম্তৃষ্ট হইল ॥
ডাকিয়া তখন কয় পদ্মাবতী প্রতি।
আজিকে তোমার গৃহ করিব বসতি ॥
দ্বার ছাড়ি দেহ পদ্মা আমার কারণ।
বসিয়া তোমার গৃহে জুড়াই জীবন ॥
শুনিয়া লক্ষ্মীর বাণী পদ্মাবতী কয়।
হেরিতেছি আজ মোর বড় ভাগ্যোদয় ॥
তেকারণে বৈকুন্ঠ-আরাধ্য দেবী যিনি
আসিয়াছে মোর গৃহে স্বয়ং সেই তিনি ॥
লক্ষ্মী কহে শুন পদ্মা আমার বচন।
মনোমত বর তুমি চাহ গে এখন ॥
শুনি পদ্মা কহে আমি এই বর চাই।
যতদিন নাহি আসি আমি এই ঠাই ॥
ততদিন এই গৃহে থাকিবে আপনি ।
এই বর মম প্রতি দেহ নারায়ণী।।
তথাস্তু বলিয়া লক্ষ্মী দিল তাহে সায়
বিদায় লইয়া পদ্ম! চলিল গঙ্গায় ॥
সজ্ঞানে গঙ্গায় পদ্মা জীবন ত্যজিল।
রথ আসি তারে লৈয়া বৈকু্ন্ঠে চলিল ॥
সত্যপাশে লক্ষমীমাতা আবদ্ধ রহিল।
জগৎ শেঠ গৃহ ছাড়ি যাইতে নারিল॥
জগৎশেঠের তুল্য কেবা হয় ধনবান।
যার গৃহে সদা রহে লক্ষ্মী বিদ্বমান ॥
বোঝো। লক্ষ্মীদেবী মনোপলি দিয়ে দিলেন জগৎ শেঠকে। পাঁচালিকার বৈকুণ্ঠ মাজি এই পালা লিখছেন যখন নির্ঘাত মীর কাশিম জগৎ শেঠের পরিবারের থেকে শেঠ উপাধি নিয়ে নিয়েছেন।লক্ষ্মীদেবী কি তখনও বসেছিলেন চন্দননগরের শেঠবাড়িতে? তবে কেমন করে দারিদ্র্যে, মন্বন্তরে লক্ষ্মীছাড়া হয়ে গেল বঙ্গভূমি?
আসলে এ হলো নেহাত গল্প। যে যুগে যেমন লোক তেমন তার লোকদেবীর গল্প। এই ধরুন সিপাহী বিদ্রোহের সময়ের এক গল্প। ইংরেজ সেনারা অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার দেশীয় সিপাইদের হাজার হাজার বিঘা জমির ধান কেটে আগুন লাগিয়ে দিল। সেই ১৮৫৭ সালে রায়গঞ্জের নিশীথসরণি এলাকার তৎকালীন জমিদার ঘনশ্যাম রায়চৌধুরী লক্ষ্মীপুজোর দিন দুপুরে দেবী লক্ষ্মীর স্বপ্নাদেশ পান বলে কথিত রয়েছে। লক্ষ্মীপুজোর রাতে কোজাগরী পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় গাছে উঠে পেঁচা ধরে সেটিকে খাঁচায় পুরে নীচে নামিয়ে আনা হত। এরপর খাঁচা সমেত সেই পেঁচাকে পুজো করার পর তার গলায় লাল ফিতে বেঁধে উড়িয়ে দেওয়া হত। পরের বছর লক্ষ্মীপুজো পর্যন্ত সেই পেঁচাটি যে সমস্ত জমির উপর দিয়ে উড়ে যাবে, সেই সব জমিতে শস্য ও আনাজের ভাল ফলন হবে বলে বিশ্বাস।
পেঁচাটা এতকিছুর পরেও বেঁচে থাকত কিনা সেসব ভেবে লাভ নেই। লোকমতে এসব হলো দৈবী ব্যাপার। তো যাই হোক, জমিদারি প্রথা গেছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে। দৈবী মহিমা তো আর আইনের উর্ধ্বে নয়! পশু পাখি রক্ষার ভার লোকদেবীর থেকে তাই রাষ্ট্রের ওপরে বর্তেছে। পেঁচা ধরার রীতিও বন্ধ হয়ে গেছে। তবে সে লক্ষ্মীপুজো এখনও চলে আসছে।
লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে কত যুগের কত গল্প লুকোনো আছে বলা শক্ত। কিন্তু যা বোঝা যাচ্ছে, পণ্ডিতরা একেবারে ঠিক কথাই বলেছেন। লক্ষ্মী হলেন কৃষির দেবী, কৃষকের দেবী।তাহলে সেই যে হরপ্পা থেকে সিপাহী বিদ্রোহ পর্যন্ত আমরা চলে এসেছি, মাঝে রাজা রানি বদলেছে, কিন্তু দেবী বদলাননি। তাই তো? তাহলে চাষ বাসের উপায় নিয়ে কী বলছে লক্ষ্মীর পাঁচালি? কোন মরশুমে বৃষ্টি ভালো? কোন বীজ কোন মাটিতে ভালো? কোন ধানের কী উপকারিতা?
এই যে? শুনেছি ছোট থেকে যে,
যদি বর্ষে আগনে,
রাজা যায় মাগনে।
তারপর,
যদি বর্ষে মাঘের শেষ,
ধন্য রাজার পুণ্য দেশ।
গোড়ায় গলদ। এ তো খনার বচন! লক্ষ্মীর পাঁচালি কোথায়?
সিংহলের রাজকুমারী হয়ে খনা এদিকে বাংলার চাষের নাড়ি নক্ষত্র বলে দিলেন, কিন্তু লক্ষ্মীর পাঁচালিতে তার টিকিটিও নেই!
কী আছে তাহলে?
লক্ষ্মীনারায়ণ ব্রত সর্বব্রত সার
এ ব্রত করিলে ঘোচে ভবের আঁধার।
বন্ধ্যা নারী পুত্র পায়, যায় সর্ব দুখ,
নির্ধনের ধন হয়, নিত্য বাড়ে সুখ।
খাস মাটির দেবী, ফসলের দেবী, প্রজননের দেবী তাঁর পুজোর পাঁচালীতে জমির স্বাস্থ্য, মেয়েদের স্বাস্থ্য, যৌন শিক্ষা নিয়ে কিছুই বললেন না?
কী করে আর বলবেন? তাঁকে কেবল সিন্দুক দেখার দায়িত্ব দিয়ে আমরা সব বিদ্যের ভার চাপিয়ে দিয়েছি সরস্বতীর ওপরে। তারপর দুই দেবীর মধ্যে কোঁদল বাঁধিয়ে তাদের ভেন্ন করে দিয়েছি। শেষে সরস্বতীর কোয়ালিফিকেশন বেঁধে দিয়েছি ইংলিশ ভিংলিশের ব্যুৎপত্তি দিয়ে।কিছু বোঝা গেল?
তাহলে পাঁচালী নিয়েই একটু কথা হোক?
লক্ষ্মী-কাব্যের আদি কবি কে, তা জানা না গেলেও রচনাকাল নিয়ে একটু আন্দাজ করা যেতে পারে। এই যে মর্ত্যলোকে প্রবল দুর্ভিক্ষ, অন্নাভাব ও হতাশার ছবি, তা দেখে মনে হয় বাঙালি ততদিনে মন্বন্তর দেখেই ফেলেছে। জগৎ শেঠের পালা তো অবশ্যই পলাশীর যুদ্ধের পর।
আরও দেখতে হবে, পাঁচালি কিন্তু কেউ সভা করে বসে কথকঠাকুরের মুখে শুনছে না। মেয়েদের সন্ধ্যাকালীন লক্ষ্মীপুজোর অঙ্গ এই পাঁচালি পাঠ। একেবারে ঘরোয়া অনুষ্ঠান।
তা ভদ্রলোকের মেয়েরা নাকি অক্ষর পরিচয় করলে ঘোর অলক্ষণ, স্বামী পটল তুলবেন এমন কুসংস্কার ছিলো তো কোম্পানির শাসন কায়েম হবার পর!
সুতরাং অনুমান করা যায়, বিদ্যাসাগরের ভদ্রলোকের স্ত্রীশিক্ষা-বিপ্লব যখন বাংলা জুড়ে বেশ প্রচার-প্রসার পেয়েছে, এ রাজ্যের ঘরে ঘরে যখন মেয়েদের সাক্ষরতা ও টুকটাক পড়াশোনা করার চল বেশ ভালোমতন মজবুত হয়েছে, তখনই এই লক্ষ্মী-মাহাত্ম্য কাব্যের প্রচার ও প্রসার।
এর সঙ্গে লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ ধরেও একটু এগোনো যাক?
অর্থনীতির ফরেন্সিকে যাকে বলে ফলো দ্য মানি। ১৮৬৭ সাল, রানীর হুকুমে মোটা ট্যাক্স বসল প্রেসে ছাপা বইয়ের ওপর। সব প্রকাশনার চাই রেজিস্ট্রেশন। আর হ্যাঁ, দুটো আনন্দমঠ লিখলে হবে বা বাছা, আগে বইয়ের কপি জমা রাখবে তারপর সরকার বাহাদুরের মন উঠলে তবে ছাপতে যাবে। রেনেসাঁ হয়ে গেছে সাঁ সাঁ করে, কোম্পানি সরিয়ে রানী নিজে বলবৎ, এখন লক্ষ্মী আর সরস্বতীকে এক ঘরে রাখাই শ্রেয় আর কি! হু হু করে ছাপা বইয়ের দাম বাড়তে লাগলো। শিক্ষা আর সকলের জন্য নয়। প্রেসগুলোর নাভিশ্বাস ওঠার দশা। সারস্বত সমাজকে রক্ষা করতে এগিয়ে এল পাঁচালী। ঘরে ঘরে তখন অক্ষর পরিচয় হওয়া কন্যেদের কেমন করে একসঙ্গে সুগৃহিনী হবার ট্রেনিং দেওয়া যায় তাই নিয়ে বেজায় গবেষণা। পাঁচালী এলো লক্ষ্মীলাভের পথ দেখিয়ে। ধর্মের ব্রতকথা বলে ট্যাক্স ছাড়। ফলে দশ পাতার পাঁচালীতে চল্লিশ পাতার বিজ্ঞাপন দিয়ে বিভিন্ন পাবলিকেশন বাঁচার অক্সিজেন পেল। এই একই কারণে একই সঙ্গে প্রদীপের তলার অন্ধকারের মতন নিষিদ্ধ বটতলার বইয়ের তুমুল উত্থান, কিন্তু পাঁচালী হয়ে রইল বেস্টসেলার।
ছাপাখানা আর প্রকাশনাগুলো খাবি খেতে খেতে টিকে গেল। সামান্য ক্ষতি হয়ে গড়িয়ে গেল বাংলার শস্যের দেবীর প্রাচীন পুজো অর্চনার বাংলা ছড়াগান। মাঝখান থেকে প্রবল হিন্দু প্রবল সনাতনী ব্রাহ্মণ মুরুব্বিরা দেখলেন এই সুযোগ। সেই যে অন্যব্রত? যারা বেদ শাস্ত্রের দেখানো পথে হাঁটে না? এই ব্রাত্য সমাজ অনার্যরাই একদিন বেদ রচয়িতা আর্য সমাজকে চাষবাস শিখিয়েছিল। গুরু দক্ষিণা স্বরূপ দেবীর অর্চনায থেকে সটান বাদ পড়ে গেল চাষবাসের কথা। থাকল নতুন যুগের ধর্মকথা।
যাও বাঙালি, ভুলে যাও তোমাদের শস্যের কোনও দেবী ছিলেন। ভুলে যাও তোমাদের প্রাচীনা ধান্যলক্ষ্মীকে। এমন পাঁচালি পড়বে তাতে ধানের কি কোনো শস্যের নামগন্ধ পাওয়া যাবে না। প্রাচীন কালের প্রধান উৎসব এবং শস্য-দেবতারা খুবই প্রসিদ্ধ বলে এই ব্রতকে হিঁদুয়ানির চেহারা দেবার জন্য এর উপর এত জোড়াতাড়ার কাজ চলেছে যে আসল ব্রতটি কেমন ছিল, তা আর এখন কতকটা কল্পনা করে দেখা ছাড়া উপায় নেই।
শুধু আছেন একজন। ব্রাহ্মণ্যবাদের সমানে সমানে লড়ে গিয়েছেন অন্যব্রতদের হয়ে। তাঁর দাঁতে বিষ, উদ্যত ফনায় অধিকার আদায় করার প্রতিজ্ঞা। কোনও কালে সপ্তডিঙ্গার মালিক চরম শৈব চাঁদ সওদাগরকে টানা থ্রেট দিয়ে দেবীত্ব অর্জন করবেন। কোনওকালে অকালবোধনের একশো আট পদ্মের জোগানদাররা কাকভোরে পদ্মগোখরোর ছোবল থেকে বাঁচতে তাঁকে ডাকবেন। পদ্মপুরাণের নায়িকা মনসা দেবীই কি কোনকালের অব্রাহ্মণ অনার্যের কমলপ্রিয়া?
সাপের কামড় থেকে বাঁচাবে তাঁর দৈবী কৃপা। আর সাপ বাঁচাবে কৃষকের মজুত শস্য, ইঁদুর খেয়ে। জৈবী কৃপা?
আর আছে উপাচার। পাঁচালি বদলে গেছে, তবু ধানের ছড়া, আলপনা, মঙ্গলঘট, - মেয়েদের মা দিদিমা শাশুড়ির থেকে শেখা সেসব ব্রতবিধির মধ্যে কে আছেন? লক্ষ্মীপুজোর ভোগের থালায় খই, মুড়কি, কদমা, বীরখণ্ডীর সূত্রেই বা কারা আসেন আমাদের রসনার ইতিহাস নিয়ে?
লক্ষ্মীপুজোর ভোগ শুনলেই খিচুড়ি, পায়েসের সুঘ্রাণ আসে নাকে, তাই না?
সাধু সাবধান! অন্নভোগের অধিকার এই সেদিনও ব্রাহ্মণদের একচেটিয়া ছিলো। এখন অবশ্য সেসব বিধি নিষেধ ঢের শিথিল হয়েছে। অন্নভোগে খিচুড়ি, ভাজা, শাক, চাটনি, তো থাকেই, পূর্ববঙ্গে অনেক পরিবারে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোয় মাছ ভোগ দেবার প্রচলন আছে, বিশেষত ঢাকা-ফরিদপুর-বরিশাল অঞ্চলে দেবীকে ইলিশ মাছভোগ দেওয়ার ব্যাপক প্রচলন ছিলো। দেশভাগ ও একাত্তরের পরে অবশ্য মানচিত্রের দৌরাত্ম্যে আঞ্চলিক প্রথা ছড়িয়ে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গে, এবং পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রবাসী অনাবাসী হবার সূত্রে গোটা ভূ ভারতে। এভাবেই কি লক্ষ্মী চঞ্চলা হয়ে যান?
এই প্রসঙ্গে লুচির প্রসঙ্গটাই এখনও উঠল না। লুচিশীল মানুষরা কুপিত হবেন না। লুচি কিন্তু মডার্ন খাবার। ময়দা খুবই কলোনিয়াল বস্তু। কিন্তু যারা অন্নভোগ দেবার অধিকারী নন, তারা দেবেন কী? লুচি, সঙ্গে তরকারি, ভাজা, সুজি দিয়ে মোহনভোগ, আবার কী? এছাড়া নাড়ুর ব্যাপারটাও আছে। তিলের নাড়ু, চিঁড়ের নাড়ু, নারকেলের নাড়ু, গুড়ের নাড়ু, ক্ষীরের নাড়ু কতরকম যে হয়! সঙ্গে থাকতেই হবে খই, খইয়ের মুড়কি, চিঁড়ে মাখা – মুর্শিদাবাদের বহু জায়গায় পুজোর উপাচার হিসাবে ‘পঞ্চ অঙ্কুরীয়’ অর্থাৎ অঙ্কুরিত ছোলা, মুগ, মটর, মসুর ও কলাই দেওয়া হয়। নারকোল কোরা দিয়ে দিনভোর ভেজানো আতপ চাল আর মুগ ফুটফুটে প্রসাদ হয়, যার নাম মুগজারা। উপোস ভাঙার এমন মোক্ষম খাবারের জুড়ি মেলা ভার।
লক্ষ্য করে দেখবেন, মা লক্ষ্মীর ভোগে অন্ন, শস্য কি সাংঘাতিক দরকারি। বচন থেকে যা তাড়ানো হলো, রসনা বাসনা থেকে তাঁকে উচ্ছেদ করা গেছে কি? রিফিউজি বাঙালির, মন্বন্তরে মরতে বসা বাঙালির জমি জমা কেড়ে নিয়েও তার লক্ষ্মী তার শ্রী কেড়ে নেওয়া গেলো?
সে ব্যাপারেও ঠিক গ্যারান্টি দেওয়া যায় না। আমরা এখন চাল বলতে বুঝি ভাত, এবং ক্যালোরি। সব চালের এক গুণ এক দোষ, ক্যালোরি গ্লুটেনে আপোষ? তুলসীভোগ, নৃসিংহজটা, সীতাভোগ সব চালের এক স্বাদ? আদৌ কেমন স্বাদ আমরা সবুজ বিপ্লব এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং হয়ে বরাবরের মতন বদলে যাওয়া বীজভোক্তারা জানি? সীতাশাল চাল ছাড়া ভালো করে সীতাভোগ হয় না, সে চাল সর্বত্র জন্মায়ও না, মনে আছে, আমরা ভোগ থেকে গুপ্তধনের পডকাস্টে বলেছিলাম?
আমরা গত পর্বে খুব আলোচনা করেছি বাংলার শষ্য, প্রজননের প্রাচীন দেবীকেই অন্যব্রতের দেবী, ব্রাত্যের দেবী বলে অলক্ষ্মী অভিধা দিয়েছিলো হিন্দু শাস্ত্র সমাজ। অলক্ষ্মীর বর্ণনা ছিলো কেমন? কালো কুচকুচে, মেজাজ খিটখিটে, গুব্দু গুব্দু পেশি, জিভের ধার খুব বেশি।
মহাভারতের মন্থনপর্ব আলোচনা হয়েছে গত পর্বে। শেষ করব রামায়ণ দিয়ে। উত্তরকাণ্ডে সীতাকে লক্ষ্মীর অবতার বলা হয়েছে, তাছাড়া গৃহলক্ষ্মী সীতার মতন হবেন এই আদর্শও তো আজকের নয়! তা গায়ের রং কেমন তাঁর? কনকবর্ণাঙ্গী বলে তাঁকে ডাকা হয় শুধু তাই নয়, তাঁর চামড়ার পাকা গমের মতন আভা আসলে দৈবী মহিমা। ঠিক মা লক্ষ্মীর মতন কিনা?
সীতা হলেন ফর্সা রঙের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর। এই সেদিন, রামায়ণ সিনেমার ফার্স্ট লুক দেখে কি ঝড়টাই না বয়ে গেল! না, রণবীর কাপুরের রাম কেন গোরা চামড়া তাই নিয়ে লোকজন বিশেষ ভাবিত নয়। কাপুর খানদানের রাজপুত্রকে আদতে নীল বা ঘন দুর্বাদলশ্যাম রঘুনন্দন মানতে খানিক কল্পনার আমদানি সহজ। কিন্তু চাপা রঙের দক্ষিণী নায়িকা সাই পল্লবী, যিনি কিনা খুলে আম ফেয়ারনেস ক্রিমের কমার্শিয়াল অফার তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন, নিজের চামড়ার রং নিয়ে গর্ব করে বলেন এটাই ভারতীয়দের আসল রং, তিনি যখন সীতার চরিত্রে মুখ দেখালেন হ্যাশটাগ আগলি ভাইরাল হয়ে উঠল। ফর্সা রং নয় যে! আমাদের জনমদুখিনী সীতামাকেও রঙের শেড কার্ড পাশ করতে হয় যে! রঙের মোহে দীপ্তির কৌটো না খুললেও আড়ালে থেকে যায় আম ভারতীয় সৌন্দর্যের মাপকাঠি। বিস্মৃতির অতলে লুকিয়ে থাকেন অদ্ভুত রামায়ণের সীতামা।
অদ্ভুত রামায়ণ? যার আরেক নাম? সীতায়ন!
এই রামায়ণের সীতা? তিনিও কি মহালক্ষ্মী?
মহালক্ষ্মী তো বটেই, এই সীতা হলেন শক্তির আধার। বাল্মীকির এই রামায়ণ স্পিন অফে ভিলেন কিন্তু দুজন। দশ মাথার রাবণ সীতাহরণের পরে রামের হাতে নিহত হলেও যুদ্ধ শেষ হয় না। উদয় হলেন দশমুন্ডুর যমজ ভাই পুষ্করের সহস্র মাথার ভয়ানক রাবণ। ফের শুরু হলো যুদ্ধ। কিন্তু এবার শ্রী রামচন্দ্র আঘাতে আঘাতে রক্তাক্ত হয়ে উঠলেন। শেষে হাজারমুন্ডুকে পরাস্ত করতে রাম ব্যর্থ হলেন।
এ হলো আক্ষরিক অর্থেই এমার্জেন্সি। দেবতারা প্যানিক করতে শুরু করলেন। রামায়ণ এভাবে বদলে গেলে তো বেজায় মুশকিল! তখন ত্রিনয়নী ভয়ংকর চামুণ্ডা মহাকালী রূপ ধরলেন, কে বলুন তো? আর কেউ নয়, আমাদের মা সীতা স্বয়ং। তাঁর তৃতীয় নয়ন উন্মোচিত হলো। মাথার পাশে উজ্জ্বল চাঁদ উঁকি মারলো। ক্রোধে কনকবর্ণা সীতা ঘোর রাত্রি মহারাত্রির অমানিশা রং ধারণ করলেন। তাঁর হাতে অমোঘ ত্রিশূল। হাজার মুন্ডুর রাবণকে নিজেই সংহার করলেন তিনি।এদিকে তাঁর এমন উগ্র রূপ দেখে রামচন্দ্রের প্রাণ যায় যায়। শেষে সহস্র নাম স্তুতির পরে সীতামা ঠান্ডা হলেন। রামচন্দ্র বললেন এই ক্রোধী যোদ্ধা সীতা তাঁর হৃদয়ে থাকুন, কিন্তু পরিচিত জগৎ জননী রূপে অযোধ্যায় তাঁকে ফেরত চাই। মৈথিলী দেবী তখন সোনালি পদ্মের মত রং, ঘ্রাণ নিয়ে তাঁর ফর্সা পরমেশ্বরী রূপে ফিরে এসে রঘুকুলোত্তমকে আশ্বস্ত করলেন।
এই অদ্ভুত রামায়ণের সন্ধান আমাদের অদ্ভুত ভারত নাই রাখুক, ফর্সা হতে না পারা মেয়েদের দিনকাল ওই নৃমুন্ডমালিনীর পুজোর বাইরে যেন একটি বেশীই কঠিন।
কালো মেয়েরা সবাই তো সাই পল্লবী নন। তাঁরা কসমেটিকসের দোকানে ঢুকে মুখ খোলার আগেই প্রথমেই সেলসের লোকজন যেটা দেখাতে নিয়ে আসে সেটা হল দোকানের সবচেয়ে দামী স্কিন হোয়াইটনিং ক্রিম। আগে ফেয়ারনেস ক্রিম বলত, এখন এই নামে চলে। ত্বকের স্বাভাবিক মেলানিনকে ধ্বংস করে ক্যান্সারের রাস্তা উন্মুক্ত করার এই সহজ রাস্তার সন্ধান কালো মেয়েদের কপালে ছাপা থাকে। তাও যে মেয়েরা বর্ণ বিদ্বেষ, লিঙ্গ বিদ্বেষ, যৌন বিদ্রূপ, বডি শেমিং উপেক্ষা করে থেকে যান সমাজের অলক্ষ্মী বিশেষণ ভূষণ করে? হয়ত তাঁদের গল্প শুনে কোনও অনার্যা প্রাচীন দেবী হেসে ফেলেন। লোকাচার উপকথা ঘন হয়ে পাক খায় লোপাট জঙ্গল, মত্ত নদী, লুপ্ত আরণ্যকের শবের ওপর। অবাধ্য বেখাপ্পা মেয়েদের পায়ের তলায় বহু জন্ম ধরে বাড়তে থাকা ঋণ থমকে যায়। বাতাসে ভেসে আসে বিগত যুগের পাগল সাধকের গান
রূপে কালী নামে কালী কাল হ'তে অধিক কালো।
ওরূপ যে দেখেছে সেই মজেছে অন্যরূপ লাগে না ভালো॥
প্রসাদ বলে কুতূহলে, এমন মেয়ে কোথায় ছিল।
না দেখে নাম শুনে কাণে মন গিয়ে তায় লিপ্ত হলো॥
তাহলে আজ এই অবধিই থাক রসমঙ্গল? আমাদের বুকে লক্ষ্মী অলক্ষ্মীর আসনে দেশীয় ধানের ঘ্রাণ বরাবর থাক? আমরা মনে রাখি অন্নের সুষম বন্টনেই মঙ্গল।
প্রকৃত রসমঙ্গল।
ধাঁধা
সমুদ্র মন্থনে ওঠেন পিঠোপিঠি বোন
একজনা দেন অমৃত, গরল অন্যজন
সর্বদোষ হরিছে গোরা, কালা করিলে ত্যাগ
ঝাঁপি আজ হলো ভাণ্ডার কে নিবে তার ভাগ?
তথ্যসূত্র
বই
- অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর. বাংলার ব্রত. 1919
- পল্লব সেনগুপ্ত. পূজা-পার্বণের উৎসকথা. 1951
- বৈকুণ্ঠনাথ মাজি. বৃহৎ লক্ষ্মী চরিত্র. 1957
- Nilima Chitgopekar. Shakti : An Exploration of the Divine Feminine. Dorling - Kindersley. 2022