ভাষ্য
উমা বিদায়ের পরে মন খারাপের অন্ধকারে এসেছে শারদ পূর্ণিমা। চন্দ্রাহত রাতে অন্যান্য দিন মেহের আলী একা জেগে সাবধান করে সাব ঝুট হ্যায়, সব মায়া হ্যায়। আইটি সেক্টরের নাইট ডিউটিরা জেগে থাকলেও তাদের কানে হেডফোন আর কল থাকে, কাজেই মেহের আলীর ডাক কেউ শোনেও না। কিন্তু এই একটি রাতে মেহের আলীর ছুটি। এই রাত জেগে থাকার রাত। বাংলার গৃহস্থ উঠোন থেকে এইচআইজি ফ্ল্যাট থেকে এলআইজি পায়রার খোপ, জেগে থাকে শহর, গ্রাম, মফস্বল, বস্তি বা বহুতলের গৃহলক্ষ্মীরা। চঞ্চলা লক্ষ্মী পা টিপে টিপে এসে দেখবেন, কে জাগে রে?
আশ্বিন পূর্ণিমা জাগে, নিশীথ পবন
ঝড় ঝঞ্ঝা পরে জাগেন লক্ষ্মী নারায়ণ
ক্ষেত জাগে, খনি জাগে, যতেক কুলি কামিন
জেগে আছে সুখী দুঃখী সকল ভক্তজন।
হিমালয় রোষে ওঠে, জগত কাতর
ভরা নদী কূল ছাপে আশ্বিন ভাদর।
মানুষের লোভে আজ মানুষেরে হানে
এসো মাগো ত্বরা করি বাংলার থানে।
লক্ষ্মী বলে ডাকি যারে করি তারে হেলা
শস্য ধান্য আজ বিষে বিষে জর্জরিলা।
অলক্ষ্মী বলে যারে দিলা নির্বাসন
সেই বুঝি করিত এই গরল নিবারণ।
ভারত পড়িব আর ধরিব রামায়ণ।
বহুকালের ইতিকথা করিব বর্ণন।
ভানু মতি ভনে শোনো অদ্ভুত এই কথা
লক্ষ্মী অলক্ষ্মীর এই আশ্চর্য গাথা।
রাত জাগার তিথি কিন্তু এক আশ্বিন পূর্ণিমার মনোপলি নয় মোটেও। এর এক পক্ষের মধ্যে কার্তিক অমাবস্যাও রাত জাগার পালা আনে। দীপাবলি যেমন শাক্ত কালীপুজোর, শ্রী রামচন্দ্রের ঘরে ফেরার দিওয়ালির, তেমনই দীপান্বিতা হেমন্তলক্ষ্মীর পুজোও বটে!
বটে? একটা র্যাপিড ফায়ার হয়ে যাক তাহলে?
হোক হোক!
লক্ষ্মী মেয়ে।
ইয়েস।
লক্ষ্মী ছেলে।
ইয়েস।
লক্ষ্মীছাড়া মেয়ে।
ইয়েস
লক্ষ্মীছাড়া ছেলে।
ভেরি ইয়েস।
অলক্ষ্মী মেয়ে।
ইয়েস।
অলক্ষ্মী ছেলে?
নো স্যার।
নন বাইনারিতে আর আমরা যাচ্ছি না, সমাজ এখনও ছেলে বা মেয়ে পরিচয়ে অনাগ্রহী বা বিদ্রোহীদের বিশেষণ খুঁজছে। তাতেও বোঝা যাচ্ছে লক্ষ্মী কেবল মেয়েদের একার বিশেষণ নয়, কিন্তু অলক্ষ্মীর ব্যাপারটা একটু আলাদা।
অথচ পুরাণ বলছে অলক্ষ্মী আর লক্ষ্মী পিঠোপিঠি বোন। অলক্ষ্মীকে জ্যেষ্ঠ হিসেবে দেখা হচ্ছে সমুদ্র মন্থনের সময়। তিনি বড়বোন। তারপরে কবে যেন অলক্ষ্মীর গায়ের রং হয়ে গেল কালো, স্বভাব কলহপ্রিয়া, চরিত্র খারাপ। শেডকার্ড মিলিয়ে এশিয়ান পেন্ট কেনার বহু আগে থেকে ফর্সা লাজুক লক্ষ্মীমন্ত বৌয়ের দিকে ঝুঁকেছে এই সমাজ। লক্ষ্মীমন্ত শান্তশিষ্ট সাবমিসিভ মেয়েগুলোর পাশে কয়েকটা জলজ্যান্ত দাঁত খিঁচোনো ইয়াব্বড় বাইসেপসওয়ালি ঝগড়ুটে এগ্রেসিভ অলক্ষ্মী কেউ চায়? কে চায়?
কোজাগরী হোক বা মেহের আলি, চন্দ্রাহত রাতে এইসব প্রশ্ন ভাবা বিশেষ পাপ নয়, কী বলেন?
আচ্ছা এই যে লক্ষ্মীমন্ত মানেই সাবমিসিভ ধরে নেওয়া হলো এর দায় কি হরপ্পার শস্যলক্ষ্মী নেবেন? বেদের লজ্জা গৌরী? কিংবা চামুণ্ডা-রূপিণী মহালক্ষ্মী? অলক্ষ্মীই বা কে? কবে কোথা থেকে এলেন তিনি? আদ্যন্ত ব্রাহ্মণ্যবাদের থিম থেকে উদ্ভূত লক্ষ্মীর পুজোই বা কিভাবে থেকে গেল মেয়েদের হাতে? ব্রাহ্মণ পুরোহিত নির্ভর বারো মাসে তেরো পার্বণে এই একটি দেবী রয়ে গেলেন মেয়েদের ব্রতকথার অঙ্গ হয়ে, কিভাবে? আসুন, সেই উত্তরগুলোই এক এক করে খোঁজা যাক?
আশ্বিনপূর্ণিমায় যখন হৈমন্তিক শস্য ঘরে আসবে, তখনকার ব্রত সন্ধ্যার সময় লক্ষ্মীপূজা। সকাল থেকে ঘরদোর আলপনায় সাজিয়ে তোলাই বিধি। লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ, লক্ষ্মীপেঁচা এবং ধানছড়া হল আলপনায় প্রধান অঙ্গ।
ধানের গোলা, ধানের শিষ এসেছে ব্রতপালনের অবশ্য উপকরণ হয়ে, আল্পনায় গলা বাড়িয়েছে পেঁচা, ময়ূরের মতন শিকারি পাখি। শস্য যাতে ইঁদুরে খেয়ে না যেতে পারে তার প্রার্থনাতেই বাহনের আহ্বান। শস্যলক্ষ্মী শস্য শ্যামলা দেশে পূজিতা হবেন, শস্য রক্ষার যাবতীয় উপায় টোটেম বা মঙ্গলচিহ্ন হয়ে উঠে আসবে চাষিঘরের পূজার বন্দোবস্তে এমনটাই তো স্বাভাবিক?
শুধু তো চাষীঘর নয়, বণিকঘরও যে আছে এর মধ্যে? লক্ষ্মীপুজোর উপকরণ গুলো ভালো করে দেখুন দেখি? কলার পেটো দিয়ে তৈরী ডিঙা রাখা থাকে দেবীমূর্তি অথবা দেবীর ঘট কিংবা সরার পাশে। এমন সাতটি ডিঙা তৈরীর রীতি আছে বলে একে বলে সপ্ততরী।
পঞ্চশস্য, টাকা দিয়ে ভর্তি করে ডোঙ্গাগুলো দেবীর আসনে রাখার বিধি, ধনী পরিবারে সোনা-রুপোও রেখে দেওয়া হয়। পুজোর শেষে নৌকাটিকে মশাল জ্বেলে সাজিয়ে পুকুরে ভাসানো হয়। এ হল বাঙালী বণিকেরা সমুদ্রপথে নৌকা নিয়ে যে সময় বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতেন সেই সময়ের স্মৃতি, সেই যে, “বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী”।
এইখানে এসে পণ্ডিতদের মধ্যে তুমুল তর্ক বেঁধে গিয়েছে। এদিকে একদল বলছেন সেই দ্বাদশ শতক অবধি অন্তত শারদীয়া কোজাগরীর সঙ্গে লক্ষ্মীপুজোর দূর দূর অবধি কোনও সম্পর্কই ছিলো না। অন্যদিকে সেন আমলের আর্যসপ্তশতি বলবে কমলপ্রিয়া লক্ষ্মীদেবীর অনুগ্রহ পেতে বণিক কেবল রাত জাগছে তাই নয়, চুটিয়ে পাশা জুয়া খেলছে। ‘উজ্জাগরেণ কৈরব কতি শক্যা রক্ষিতুং লক্ষ্মী”
কিন্তু লক্ষ্মীপূজো নিয়ে তর্কই বা উঠছে কেন? এই তো, ময়মনসিংহ গীতিকায় সেই চারশ পাঁচশো বছর আগের রূপকথা দেখুন, কাজলরেখা কী আল্পনা এঁকেছিল সূঁচরাজার জন্য?
উত্তম সাইলের চাউল জলেতে ভিজাইয়া।
ধুইয়া মুছিয়া কন্যা লইল বাটিয়া॥
পিটালি করিয়া কন্যা পর্থমে আঁকিল।
বাপ আর মায়ের চরণ মনে গাঁথা ছিল॥
জোরা টাইল আঁকে কন্যা আর ধানছড়া।
মাঝে মাঝে আঁকে কন্যা গিরলক্ষ্মীর পারা॥
শিব-দুর্গা আঁকে কন্যা কৈলাস ভবন।
পদ্মপত্রে আঁকে কন্যা লক্ষ্মী-নারায়ণ॥
হংসরথে আঁকে কন্যা জয়া-বিষহরী।
ডরাই ডাকুনী আঁকে কন্যা সিদ্ধ বিদ্যাধরী॥
বন দেবী আঁকে কন্যা সেওরার বনে।
রক্ষাকালী আঁকে কন্যা রাখিতে ভুবনে॥
কার্ত্তিক গণেশ আঁকে কন্যা সহিত বাহনে।
রাম সীতা আঁকে কন্যা সহিত লক্ষ্মণে॥
গঙ্গা গোদাবরী আঁকে হিমালয় পর্ব্বত।
ইন্দ্র যম আঁকে কন্যা পুষ্পকের রথ॥
সমুদ্র সাগর আঁকে চান্দ আর সূরযে।
ভাঙ্গা মন্দির আঁকে কন্যা জঙ্গলার মাঝে॥
লোককথার গান এক, আর ইতিহাসের গতি আরেক। কোজাগরী পূর্ণিমার ব্রত আর লক্ষ্মীপূজো - বাঙালি কোন ঘটে কী জল ভরল, তার হদিশ হয়ত দিতে পারেন আমাদের কাব্যে উপেক্ষিতা অলক্ষ্মী। সে কথায় আসছি একটু পরে। প্রথমে দেখে নিই বাংলার প্রচলিত লক্ষ্মীপূজো কোন কোন সময়ে হয়।
ভাদ্রমাসের শুক্লপক্ষের বৃহস্পতিবার ভাদ্রলক্ষ্মী,
আশ্বিন মাসের পূর্ণিমায় কোজাগরী লক্ষ্মী,
কার্তিকের দীপান্বিতা অমাবস্যার মহালক্ষ্মী,
অঘ্রান সংক্রান্তির ক্ষেত্রলক্ষ্মী,
পৌষ মাসের শুক্লপক্ষের পৌষলক্ষ্মী,
মকরসংক্রান্তির অরুণালক্ষ্মী,
মাঘ মাসের প্রথম দিনের উঠোনলক্ষ্মী,
চৈত্রমাসের শুক্লপক্ষের বৃহস্পতিবারের চৈতেলক্ষ্মী।
যে সিজনে খারিফ শস্য সেই দেবীর গ্ল্যামার বেশি। রবি শস্যের সময়ে ধুমধাম একটু কমের দিকে। আর বাণিজ্যে গেলেন যে বাঙালি সওদাগর?
আমাদের যেমন ভাদ্রলক্ষ্মী বা শারদলক্ষ্মী ব্রত, তেমন এক ব্রত ‘ভাদুলি’। বৃষ্টির পরে আত্মীয়স্বজনের বিদেশ থেকে, সমুদ্রযাত্রা থেকে, জলপথে স্থলপথে নিরাপদে ফিরে আসার কামনায় মেয়েদের ব্রত। ভাদুলির মূর্তির চারিদিকে নদী সমুদ্র কাঁটাবন নানা হিংস্র জন্তু নৌকো ইত্যাদি আলপনা দিয়ে, এই ব্রত করা হয়। এক-একটি আলপনার চিত্রে ফুল ধ’রে, এবং সেই আলপনা যে কামনার প্রতিচ্ছবি একটি পর একটি ছড়ায় সেই কামনাটি উচ্চারণ ক’রে-যেমন নদীর আলপনায় ফুল ধ’রে বলা “নদী, নদী! কোথায় যাও? বাপ-ভায়ের বার্তা দাও!’- এমনি প্রত্যেকবার ভিন্ন ভিন্ন আলপনাতে রকম-রকম ছড়া ব’লে ফুল ধ’রে ভাদুলিকে প্রণাম করে ব্রত শেষ। পুরুত টুরুত কিছু লাগবে না, ব্রত শেষে পাঁচ সাত ঘরের মেয়েরা এসে গল্প গুজব খাওয়া দাওয়া করে দুর্দান্ত বন্ডিং করে তবে যাবে। এমনধারা বাংলার বাইরে কোথায় পাবে?
তেমন করে চাইলে পাবে বই কি? মেক্সিকোর ‘হুইচল’ জাতির মধ্যে বৃষ্টি কামনা করে একটি ব্রত চালু ছিলো। একটি মাটির চাকতি বা সরা হলেন আরাধ্যা; তাঁর একপিঠে আলপনা দিয়ে সূর্য আঁকা হলো, এরই চারি দিকে সরার কিনারায় সব পর্বতের চূড়া, ধারে ধারে ধানখেত বোঝাবার জন্যে লাল ও হলুদের সব বিন্দু; তারই ধারে বৃষ্টি বুঝিয়ে কতকগুলি বাঁকা বাঁকা টান সবার জন্য পিঠে লাল-নীল-হলুদে রঙের বাণে-ঘেরা চক্রাকার সূর্যমূর্তির আলপনা লিখে পূজাবাড়িতে রেখে ব্রত করা। হয়তো এই আলপনা দিয়েই ব্রত শেষ, হয়তো বা ছড়াও কিছু বলা হত! কালের চক্করে সেসব কোথায় হারিয়ে গিয়েছে!
কি আশ্চর্য দেখুন, সেই অন্য গোলার্ধের দেশের উপজাতির মতন বাঙালিও লক্ষ্মীপুজো ঘটে, পটে, সরায় করে আসছে সেই কবে থেকে। মাটির বড় ঢাকনাতে দেবী ও তার সাথে সম্পর্কিত টোটেম যেমন প্যাঁচা, ধানের শীষ ইত্যাদি আঁকা হয়।
অঙ্কনশৈলীর তারতম্য বিশেষে লক্ষ্মীর সরা ছিলো চার প্রকার – সুরেশ্বরী, ফরিদপুরী, ঢাকাই আর গণকী। ফরিদপুরের সুরেশ্বর গ্রাম থেকেই নাকি এর উৎপত্তি, পরে তা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা ও ফরিদপুর জেলার অন্যান্য অঞ্চলে।
তা ছিলো বলছি কেন?
কারণ দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গ থেকে বিপুল পরিমাণে হিন্দুদের দেশত্যাগের পর থেকে বর্তমানে নদীয়ার তাহেরপুর, উত্তর চব্বিশ পরগণার নানা জায়গায় সরা আঁকা হয়। পুজোর কদিন আগে থেকে তা পাওয়া যায় শহরের নানা জায়গায়। রাতারাতি পাকা ভিটে, গোলাভরা ধান, বিলের তাজা মাছ, আপনজন ছেড়ে একবস্ত্রে রিফিউজি হয়ে আসা বাঙালি ধীরে ধীরে পায়ের তলার মাটি শক্ত করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ঘটে পটে ফিরিয়ে এনেছে তাদের কোজাগরী আরাধ্যা দেবীকে। যে ইতিহাস দেশভাগের রাজনীতি, এথনিক ক্লিনসিংয়ের দমননীতি, একাত্তরের পাকিস্তান ভাগের, ভাষা আন্দোলনের ক্রাইসিস লিখে রেখেছে তার তো দায় পড়েনি মধ্যবিত্ত বাঙালির শাঁখ উলু বাজিয়ে কোজাগরী ব্রতের বহতা ধারার সঙ্গে শিল্প, অর্থনীতির নেওয়া বাঁক ফিরে দেখার। সে দায় বরাবরের মতন নিয়েছেন লোকদেবী। কে বলতে পারে, পাঁচশো বছর পরেও বাঙালি টিকে থাকলে লোককথায় হয়তো থাকবে পূর্ববঙ্গের ভিটে ছেড়ে আসার যন্ত্রণার কাহিনী, রিফিউজি থেকে নাগরিক অধিকার পাবার কাহিনী?
সে নিয়ে আমরা এখন কিছু বলতে পারি না। মেক্সিকান রীতির সঙ্গে এইসব লক্ষ্মীর সরার আর্টের মিল আছে কিনা সেও কেবল পণ্ডিতেরাই বলতে পারবেন।
আমরা যারা হাঁ করে শুধুই দেখি তারা যদি ব্রত ব্যপারখানা ভালো করে দেখি দুই আশ্চর্য বিপরীত শক্তি দেখতে পাই। একদিকে মূলধারার ধর্ম। সে আমেরিকায় খ্রিস্ট হোক, মেসোপটেমিয়ায় ইসলাম কি ভারতে হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদ, তারা মূলধারার নির্দিষ্ট টেক্সট মোতাবেক জিনিসপত্র ছাড়া অন্যান্য উপজাতির ধরন ধারণ বার ব্রত একেবারেই পছন্দ করে না। পিতৃতন্ত্রের দাপট ধর্মের আসনে উঠলে সবচেয়ে শক্তিশালী সে আমরা সবাই জানি। তাদের শাস্ত্রীয় ব্রতে যারা চলে না তারা অন্যব্রত। যাকে আবার বলা যায় ব্রাত্য। আর যে অন্যব্রত জাতি তাদের নিজস্ব পূজোপাঠ করে চলেছে? তাদেরও দায় থাকে পিতৃতন্ত্রের সঙ্গে হাত পা মিলিয়ে চলার। যেমন দেখুন, লক্ষ্মীপুজোর বাঙালি মন্ত্র বলছে
রণে রণে এয়ো রব, জনে জনে সুয়ো হব, অকালে লক্ষ্মী হব, সময়ে পুত্রবতী হব।
নারী সটান সপাট জানিয়ে দিচ্ছে তার স্বামীভাগ্য, ধনভাগ্য, সন্তানভাগ্য এক নিক্তিতে বাঁধা। সে নিজে যুদ্ধে আর যায় না, কিন্তু তার স্বামীর যুদ্ধজয়ের প্রার্থনায় তার ব্রত থাকছে থাকবে।
তা ধরুন মেয়েরা যুদ্ধে চলেই গেল। যেতেই পারেন। ঝাঁসির রানি যুদ্ধ করে অমর হয়ে গিয়েছেন। তারপর ধরুন পুরাণে সব দেবতা যখন মহিষাসুরকে মারতে ব্যর্থ তখন আমাদের হিমালয় কন্যা চামুণ্ডা রূপ ধরছেন। এনারা হলেন আমাদের দুর্গা তাই তো? এই তো কিছুদিন আগেই দুর্গাপুজো গেল। বোধনে নবপত্রিকা তো ছিলই। সেখানে আসলে কী কী থাকে?
বলা ভালো, কে কে থাকেন? কলা অর্থাৎ ব্রহ্মাণী, কচু অর্থাৎ কালী, হলুদ যা কিনা দুর্গা, জয়ন্তী (কার্তিকী), বেল অর্থাৎ শিবা, ডালিম রূপে রক্তদন্তিকা, অশোক যা কিনা শোক-রহিতা, মানকচু অর্থে চামুণ্ডা এবং ধান। অর্থাৎ লক্ষ্মী।
বেশ বেশ। তাহলে মেয়েরা কেবল গৃহলক্ষ্মী নন, সময় এলে তাঁরা দুর্গা রূপও নিচ্ছেন। ঠিক?
ভুল। মনে রাখতে হবে যে মেয়ে যুদ্ধে যাচ্ছেন তিনি লবি হিসেবে পাশে কাকে পাচ্ছেন। মূলধারার ধর্ম, জাতি? নাকি অন্যব্রত ব্রাত্য জাতি উপজাতি? যদি ঝাঁসির রানী হন তাহলে প্রথমটা। আর যদি কর্ণগড়ের রানী শিরোমণি হন?
ঝাঁসির রাণী লক্ষ্মীবাই-র বিদ্রোহের অর্দ্ধ শতক আগে বিদ্রোহিনী রাণী শিরোমণি; যিনি চুয়াড় পাইকদের সঙ্গে নিয়ে ব্রিটিশ কোম্পানির বিরুদ্ধে জঙ্গলমহল জুড়ে গণ অভ্যুত্থান ঘটাবেন?
সময় ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দ। নিষ্কর জঙ্গলমহলে কর বসিয়ে কোম্পানি তখন জমিদারি নিলামে তুলেছে। রাতারাতি কর্মহীন ভূমিহীন হয়ে পড়েছেন জমিদার এবং তাঁর পাইক বরকন্দাজ লেঠেল বাহিনী। এই বিপুল শক্তিকে একসঙ্গে করে সুনিপুণ স্ট্রাটেজি দিয়ে ব্রিটিশ বাহিনীকে চুয়াল্লিশ বছরের জন্য রুখে দিল চুয়াড় বিদ্রোহ। দীর্ঘ সময় ধরে নেতৃত্বে কে? কর্ণগড়ের চুয়াড় বংশীয় জমিদার রাণী শিরোমণি। এই বীর নারী কী স্ট্যাটাস পেলেন জঙ্গলমহলের বাইরে? লোককবি বলছেন
কর্ণগড়ের রানি মাগো অস্ত্র ধরেছিল
কলকেতার লোকে তাকে চুয়াড় বলেছিল।
অর্থাৎ মেয়েরা যদি স্বামী সেবা , সন্তান ধারণ প্রায়োরিটি না দিয়ে ঘরের বাইরে গিয়ে যুদ্ধে নামে, যদি তাদের পেশি কোমল পেলব না হয়ে লোহার মতো শক্ত হয়? যদি অন্যায় দেখলে সে দাঁত খিঁচিয়ে তেড়ে আসে? যদি সে মেয়ে মুখরা হয়, উচিত উত্তর দেয়?
চেনা চেনা লাগছে না লক্ষণগুলো? অলক্ষ্মীর ধ্যানে কোন কোন লক্ষণ ছিলো, মনে আছে?
আসুন, বেদ পুরাণের দিকে ফের একবার তাকানোর সময় এসেছে। পুরাণে বলে লক্ষ্মী দেবসেনা রূপে জন্ম নিয়ে কার্তিকেয়র পত্নী হন এবং যুদ্ধে মন দেন। আবার কোথাও তিনি গণেশপত্নী। কোথাও বিষ্ণুজায়া। একেবারেই সূচনায় বৈদিক লক্ষ্মী শস্য-সম্পদের দেবী ছিলেন না। নদীরূপিণী সরস্বতীই ঊর্বরতা, শস্যদায়িনী দেবী। মনে রাখবেন, বেদ জন্ম নিয়েছে বহতা সরস্বতীর উর্বর পাড়ে। এরপর ধীরে ধীরে সরস্বতী শুকিয়ে এসে অন্তর্লীনা হয়ে উঠলেন। গঙ্গা মর্ত্যে এলেন, বা বলা ভালো বাঁধের কল্যাণে গঙ্গার পলিমাটিতেও চাষ বাসের সূত্রপাত হলো। শস্যের বা সম্পদের দেবী হিসাবে লক্ষ্মী আলাদা জায়গা পেলেন। মহাভারতের সমুদ্র মন্থনের গল্প ততদিনে এসে উপস্থিত। কোন তিথিতে হলো মন্থনকান্ড?
এইবার আমরা কোজাগরী থেকে পনেরোদিন এগিয়ে যাব। কার্তিক অমাবস্যার রাতে দীপান্বিতা লক্ষ্মীপুজো বর্হিবঙ্গের সুপরিচিত একটি ধর্মীয় আচার। আচ্ছা, অমাবস্যার রাতে লক্ষ্মীপুজো কেন ? অমাবস্যা তো কালীপুজোর জন্য নির্দিষ্ট, তায় আবার কার্তিকী অমাবস্যা ! এসময়ে সূর্যদেব থাকেন তুলারাশিতে অর্থাৎ নিচস্থ অবস্হায়। বলা হয় বছরের সবচেয়ে গাঢ় অমাবস্যা এটি। সেই তিথিতে লক্ষ্মীপুজো ?!
আসলে পুরাণে বলছে এই তিথিতেই সমুদ্র মন্থনের সময় শ্রী ও সম্পদের দেবী লক্ষ্মীর আবির্ভাব। স্মার্ত রঘুনন্দন ভট্টাচার্য তাঁর গ্রন্থে দীপান্বিতা লক্ষ্মীপুজোর বিধান দিয়েছেন। অলক্ষ্মী বিদায় দীপাবলীর লক্ষ্মীপুজোর একটি অন্যতম প্রধান অংশ। দীপান্বিতা পুজোর আগে হয় অলক্ষ্মীর পুজো। বলা হয়েছে, তিনি কৃষ্ণবর্ণা, ক্রোধী ও কলহপ্রিয়া। তিনি লোহার আবরণ ও মলিন বস্ত্র পরিহিতা, তৈলাক্ত গাত্র, বাম হস্তে ঝাঁটা ও ডান হাতে কুলো নিয়ে গাধার উপর বসে আছেন। মূর্তিটা চেনা চেনা লাগছে?
তারপরে অলক্ষ্মীর কি গতি হয়?
গোবর দিয়ে অলক্ষ্মীর তিন-চার ইঞ্চি উচ্চতার একটি পুতুল গড়া হয়। পুজোর স্থানে আল্পনা দেওয়া হয় না, ধূপ-ধুনোর পরিবর্তে লঙ্কা দিয়ে ঘুঁটের ধোঁয়া, নতুন কাপড়ের বদলে পুরোনো ছেঁড়া কাপড়, শাঁখ-ঘন্টার পরিবর্তে টিন ও কুলো বাজিয়ে পুজো, ডান হাতের পরিবর্তে বাম হাত দিয়ে ফুল নিয়ে পেছনে ছুঁড়ে ফেলতে হয়।
গাঙ্গেয় ভূমির লোকাচার হিসেবে দীপান্বিতা বেজায় জনপ্রিয়। বিশেষত ভাগীরথী অঞ্চলে ও যশোর এবং খুলনা জেলায় এই লক্ষ্মী অলক্ষ্মী পুজোর প্রচলন। দীপান্বিতার সন্ধ্যায় লক্ষ্মী ও মধ্যরাত্রে কালীপূজা – এই হল রীতি। পাড়াগাঁয়ে মেয়েরা অলক্ষ্মী-বিদায় নিজেরা করেন না; পূজারিকে দিয়ে কিংবা পাড়ার ছেলেপুলেদের দিয়ে এ-কাজ সারা হয়। এই অলক্ষ্মীই কী অন্যব্রতদের লক্ষ্মী বা শস্যদেবী?
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলার ব্রত বইয়ে এই সুবাদে হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদকে তুলোধনা করেছেন। তাঁর বক্তব্য হলো শাস্ত্র নিজেদের বর্ণে গন্ধে রাষ্ট্রযন্ত্রে কমপ্যাটিবেল মা-লক্ষ্মীকে এই প্রাচীনা লক্ষ্মীর স্থানে বসিয়ে পুরনো দেবীকে অলক্ষ্মী নাম দিয়ে কুরূপা-কুৎসিত বলে একে ছেঁড়া চুল ও ঘরের আবর্জনার সঙ্গে বিদায় দিতে চাইলেন। মেয়েরাও ব্রহ্মকোপের ভয়ে অলক্ষ্মীর পূজা জায়গা বাইরেই করলেন; এবং যথাবিধি পূজা করা না-করার দায়-দোষ সমস্তই পুরুত ঠাকুরকেই নিতে হলো। এদিকে প্রাচীনা লক্ষ্মীকে একেবারে বাদ দেওয়া কিংবা যাচ্ছেতাই অপমান কোনোটাই মেয়েরা করতে ইতস্তত করলেন। এখন অলক্ষ্মী বলুন আর যাই বলুন, এক সময় তিনি তো লক্ষ্মী বলেই চলেছিলেন, পূজারীও তো এ দেশেরই লোক। ধর্মভয় তাঁরও আছে। তাই ঘরের বাইরে হলেও মা-লক্ষ্মীর আগে অলক্ষ্মীর পূজা হবে স্থির হলো। তাই অলক্ষ্মীর মূর্তি সবসময় ঘরের চৌকাঠের বাইরে রাখা হয়, কখনো ঘরে তোলা হয় না। পুজো হয় উঠোনে, ছাদে বা বাড়ির বাইরে কোন স্থানে।
অবন ঠাকুরের এই বিশ্লেষণ পণ্ডিতেরা কাটতে পারেননি। তিনি প্রমাণ হিসেবে অলক্ষ্মীর ব্রতকথাই ধরছেন। সেখানে অলক্ষ্মী আর লক্ষ্মী পুজো নিয়ে গোলযোগ আছে তাই নয়, রাজার রাজধর্ম পালনের মধ্যে মন্দা বাজারে মূলধন বিনিয়োগও সে গল্পের এক আশ্চর্য উপকরণ।
এক দেশের রাজার নিয়ম ছিল হাটে কেউ কিছু যদি বিক্রি করে উঠতে না পারত, তবে তিনি রাজভাণ্ডার থেকে হাট শেষ হলে হতাশকে সান্ত্বনা দেবার জন্য ঝড়তিপড়তি সবই নিজের জন্যে কিনে রাখতেন। এমনি একদিন এক লোহার দেবীমূর্তি এক কামারের কাছ থেকে হাট শেষে রাজা কিনলেন, কামার যখন রাজবাড়ির সামনে দিয়ে হেঁকে যাচ্ছিল। রাজা সত্যপালনের জন্যে সেই লোহার দেবী কিনলেন এবং ঘরে আনলেন । লোহার মূর্তি ছিল অলক্ষ্মী; লক্ষ্মী অমনি সেই রাত্রেই বিদায় হয়ে যান; রাজা বললেন, আমি সত্যপালন করেছি এতে দোষ কী? লক্ষ্মী রাজাকে বর দিলেন, তিনি পশুপক্ষীর কথা বুঝবেন কিন্তু লক্ষ্মী আর রাজ্যে রইলেন না। এমনি-এমনি প্রথমে রাজলক্ষ্মী তার
পর ভাগ্যলক্ষ্মী, যশোলক্ষ্মী, সবাই একে-একে গেলেন; তার পর ধর্ম আর কুললক্ষ্মী চলেছেন। রাজা ধর্মকে বললেন—কুললক্ষ্মী যেতে চান তো যান, কিন্তু ধর্ম, আপনিতো যেতে পারেন না, কেননা আমি সত্যধর্ম পালন করতেই এ কাজ করেছি।
ধর্মরাজ বাড়িতেই রইলেন। এর পর ভুল বোঝাবুঝির চোটে রাজা রানীকে দিলেন তাড়িয়ে। রানী বহু দুঃখ কষ্টে কোজাগরী লক্ষ্মীপূজো ক’রে তবে রাজার লক্ষ্মী ফিরিয়ে আনলেন। রাজার রাজ্য ফিরল। রাজা রানির মিল হয়ে গেল যারে কয় হ্যাপি এন্ডিং। তবে অনার্য দেবীর জন্য হ্যাপিলি এভার আফটার হলো না বটে। । দুই ধর্ম, দুই দেবী, দূই দল মানুষের যে দুই পূজো নিয়ে একটি বেশ গোলযোগ চলছিল এবং শেষে নতুন লক্ষ্মীই যে দেশের প্রাচীন লক্ষ্মীর পূজা দখল করেছিলেন তা যেমন বোঝা গেল তেমন এও মনে থাকলো যে হাটে যে প্রাচীনা লক্ষ্মী মূর্তি বিক্রি হতে এসেছিল তাঁকে রক্ষা করাও ছিলো রাজধর্ম।
বেশ। এবারে অলক্ষ্মীর মূর্তিটি আরেকবার মনে করুন দেখি? গাঁট্টা গোট্টা চেহারা, হাতে ঝ্যাঁটা, গাধার পিঠে আসীন কোন দেবীকে মনে পড়ছে? লক্ষ্মীপুজোর সিজনের বাইরে যে শীতলাদেবী বারে বারে বিবিধ রূপে অরণ্য রক্ষায়, সন্তান রক্ষায়, রোগ ব্যাধি থেকে রক্ষার জন্য ভক্তকুলে পূজিত হন, তিনি কেন এমন অনার্যের আরাধ্যা রূপটি নিয়ে অলক্ষ্মী ধ্যান মন্ত্রে উঁকি দিয়ে যান? রং কালো, মেজাজি, মুখরা, শক্তিশালী মেয়েমানুষ মানেই অলক্ষ্মী? নাকি, রাক্ষসী? নাকি জগৎজননী?
সে প্রশ্নের সমাধান হবে, পরবর্তী পর্বে। লক্ষ্মী দেবীর পায়ের ছাপ ধরে ধরে কোথায় গিয়ে পৌঁছাব আমরা? দেখা যাক?
আজ রসমঙ্গল এই অবধিই। আমাদের বুকে লক্ষ্মী অলক্ষ্মীর আসনে দেশীয় ধানের ঘ্রাণ বরাবর থাক। আমরা মনে রাখি অন্নের সুষম বন্টনেই মঙ্গল।
প্রকৃত রসমঙ্গল।
ধাঁধা
সমুদ্র মন্থনে ওঠেন পিঠোপিঠি বোন
একজনা দেন অমৃত, গরল অন্যজন
সর্বদোষ হরিছে গোরা, কালা করিলে ত্যাগ
ঝাঁপি আজ হলো ভাণ্ডার কে নিবে তার ভাগ?
তথ্যসূত্র
বই
- অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর. বাংলার ব্রত
- পল্লব সেনগুপ্ত. পূজা-পার্বণের উৎসকথা
- ময়মনসিংহ গীতিকা. কাজলরেখা
- Nilima Chitgopekar. Shakti : An Exploration of the Divine Feminine
প্রবন্ধ
- বাংলার লক্ষ্মীকথা – কোজাগরী লক্ষীপুজো. Prajnanam.com. 2020-05-07
- বাংলার লক্ষ্মীকথা – দীপান্বিতার মহালক্ষ্মীপুজো. Prajnanam.com. 2020-05-09
- কোজাগরীতেও অমানিশার ছায়া, হোক অলক্ষ্মী বিদায়. Anandabazar.com