ভূমিকা
পরাধীন ভারতের দুঁদে পুলিশ অফিসার চার্লস টেগার্ট তিরিশ বছরেরও বেশী সময় কাটিয়েছেন বাংলায়। অগ্নিযুগে সশস্ত্র ব্রিটিশ পুলিশ অফিসারের দৃষ্টিকোণ থেকে বিপ্লবের জানা-অজানা কাহিনী নিয়ে তৈরি শ্রুতিনাটক টেগার্টের ডায়েরি।
আমাদের এই চ্যাপ্টারে আছেন এক ব্ল্যাক উইডো। তিনি হলেন ননীবালা দেবী। এলিট স্পাই নন, ইনফিনিটি স্টোনের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেননি, তবে যুগান্তর সমিতির একখানি লুকোনো রিভলবারের সুলুক সন্ধান এনে দিয়েছিলেন ব্রিটিশ পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে।
ননীবালা দেবী। বাংলার প্রথম মহিলা রাজবন্দী। অফিসিয়ালি প্রথম থার্ড ডিগ্রী খাওয়া মহিলা রাজবন্দী ননীবালা দেবী। শরীরে দুবাটি লঙ্কাবাটা ঢোকানোর পরেও মুখ না খোলা ননীবালা দেবী।
ইংরেজ সরকার বাহাদুরের চোখে ধুলো দিয়ে দেশের কাজ করে যাওয়া আমাদের ঘরের মেয়ে, যিনি জেল থেকে বেরিয়ে চরকা কেটেছেন বস্তিতে বাসা নিয়ে। স্বাধীনতার আগেও, পরেও।
একদিন জেল খেটে অনেক তথাকথিত স্বাধীনতা সংগ্রামী পরে বড় নেতা হয়েছেন, আখের গুছিয়েছেন। তিনি চরকাই কেটে গেলেন। কে জানে কেন?
টেগার্টের ডায়রীর দ্বিতীয় পর্ব, নির্মিত হয়েছে বাংলার প্রথম মহিলা রাজবন্দী ননীবালা দেবীর ওপরে। শ্রুতিনাটকের কিছু সংলাপ এখানে রইল।
নির্বাচিত চিত্রনাট্য
9th September 1915. A day to celebrate, a day to remember. বাঘা যতীনকে সেদিন বুড়ি বালামের তীরে ঝাঁঝরা করে দিয়ে আমরা দুটো যুদ্ধ জিতেছিলাম। পাঁচজন ভারতীয় বিপ্লবীর মাউজার পিস্তলের বিরুদ্ধে আমাদের মডার্ন রাইফেল ফোর্সের একটা যুদ্ধ। আর জার্মানির বিরুদ্ধে আরেকটা যুদ্ধ। দ্য ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড ওয়ার ওয়াস ইন ফুল সুইং দেন। জার্মানির জাহাজভর্তি অস্ত্র বাঘা যতীনের হাতে এলে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার দুর্দিনের শেষ থাকত না। উই ওয়ান। পিরিয়ড।
অথচ নেটিভদের এই ভাষায় লিখতে বসলে আমাদের ব্যর্থতাগুলোই আগে মনে পড়ে। হমম, কালা কুত্তাগুলোকে আমি যে কত ঘৃণা করি, এটাই বোধহয় তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। হ্যাঁ, বাঘা যতীনকে আমি দাঁড়িয়ে গুলি করে মেরেছিলাম, ইন ওপেন ফুল ফ্লেজেড ব্যাটেল।
কিন্তু আত্মতুষ্টিতে ভোগবার রোগ আমাদের, বিশেষ করে আমার, চার্লস অগস্টাস টেগার্টের নেই। বাঘা যতীনকে খতম করার পর আমার মূল লক্ষ্য ছিল ওর ডান হাত অমরেন্দ্রকে খুঁজে বার করে আন্দামানে পাঠানো। অমরেন্দ্র চ্যাটার্জি। আমাদের সমস্ত ইন্টেলিজেন্স মিলেও খুঁজে বার করতে পারেনি ওকে, মেঠো ইঁদুরের মত পালিয়ে বেড়িয়েছে আমাদের হাতকড়া এড়িয়ে। তবে ওর সুবাদে ননীবালাকে আমরা পেয়েছিলাম হাতের মুঠোয়। ডার্লিং ননীবালা! বেঙ্গলের প্রথম মহিলা রাজবন্দি। মেয়েছেলে নাকি করবে রাজদ্রোহ! হা হা হা হা।
ননী
বাবা অমর,
চন্দননগরে তোমাদের থাকার চিন্তা এবারে ঘুচল। বেশ বড় একখানা বাড়ি পেয়েছি, সামনে উঠোন, পাকা পায়খানা, সব আছে। তোমাদের প্রাণ হাতে করে গাড়ু নিয়ে পুকুরে যেতে হবে না বাহ্যি করতে। আর বাইরের দালান থেকে ভেতরবাড়ির রাস্তা বেশ খানিকটা। মাখনদাদা বললে এতে মস্ত সুবিধে হল, পুলিশ টুলিশ এলে তাদের ঘরে ঢোকবার আগেই দলের ছেলেরা পেছনের দরজা দিয়ে পালাতে পারবে। আমি মাখনদাদাকে বলে দিয়েছি, কোনো ভাবনা নেই। আমি তো রইলাম চৌকিদার, দেখি কোন লালমুখো মিনসে আমাকে পেরিয়ে তোমাদের গায়ে হাত দেয়? মাখনদাদা তো আমাকে পিস্তল চালানো শেখাবে বলেছে। আমাদের হরিছোঁড়া তাই শুনে হেসেই খুন। বলে ননীপিসি যেমন পোস্ত বাটে তেমনিই থাক। মেয়েমানুষের হাতে পিস্তল দিয়ে আর কাজ নেই।
আচ্ছা অমর, মেয়েমানুষের জীবন কি এতই অকাজের? আমি হিঁদু ঘরের বালবিধবা, এতে আমার হাত কী বলতে পার বাবা? কতটুকু বয়সে বিয়ে, কতটুকু বয়সে কপাল পুড়ল আমার, সে সোয়ামী সংসারের দিনগুলো এখন মনেও পড়েনা। এই পঁচিশ ছাব্বিশ বচ্ছর বয়স অবধি যখন যমের অরুচি হয়ে আছি, তখন নাও না কেন আমাকে তোমাদের দলে? মা কালীর কাছে বুকের রক্ত দিয়ে বলব বন্দে-মাতরম। শপথ নেব, যেমন যতীনবাবু তোমাকে দীক্ষা দিয়েছিলেন, তেমন! বিশ্বাস কর, আমাকে নিয়ে তোমরা ঠকবে না বাবা। এ দেশ যেমন তোমাদের মা, তেমনি আমারোও তো মা, তাই না? এইটুকু বয়স তোমাদের, জীবন তুচ্ছ করে তোমরা দেশের কাজে ঝাঁপিয়েছ, মেয়েমানুষ বলে আমাকে দূরে সরিয়ে রেখো না বাবা।
মাখনদাদার হাতে এই চিঠির সঙ্গে নিম- শুক্তো পাঠালাম। তোমার জ্বর মুখে জিভে সোয়াদ আসবে দেখে নিও। চন্দননগরে শিগগিরই চলে এসো, কলকাতায় লালমুখোরা তোমাকে খুঁজছে যে।
আমার আশীর্বাদ নিও।
তোমার ননীপিসি।
টেগার্ট
মেয়েদের জায়গা বিছানায় আর রান্নাঘরে। হ্যাঁ আমাদের দেশে পারফেক্ট ওয়াইফরা সেবামূলক কাজও করে,শিকারে যায়, হাজব্যান্ডের জন্য পার্টি দেয়, তো সে তো আমাদের সভ্যদেশের কথা। এটিকেট জানা আইডিয়াল আইরিশ, ইংলিশ উওম্যান কোথায় আর এই নোংরা অসভ্য ইন্ডিয়ার অশিক্ষিত মেয়েছেলে কোথায়! তাই ননীবালাকে দিয়ে ওদের সমাজে একটা মেসেজ পাঠানো দরকার ছিল। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ায় থেকে government এর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহ করলে তার পরিণতি কী হয় তার এক্সাম্পল করতে চেয়েছিলাম আমরা ননীবালাকে। হমম, ইট ওয়াস আ সাকসেস আই থিঙ্ক, তবে হ্যাঁ, মেয়েটার জেদ ছিল। অবশ্য জেদ না থাকলে এই দেশের একটা হিন্দু বিধবা, বেশ্যাও নয়, সে মাথায় সিঁদুর দিয়ে বিপ্লব করবে, ইভেন আই ওয়াস সারপ্রাইজড, ফর আ হোয়াইল।
অমর
পিসি, ভেবে দেখ। এ বড় কঠিন কাজ। একচুল এদিক ওদিক হলে ধরা তো পড়বেই, রামবাবুর থেকে পিস্তলের হদিসও আর পাব না। মাউজার আমাদের আর নেই, যতীনদার শেষ যুদ্ধে বুড়ি বালামের তীরে সর্বস্ব হারিয়েছে। উনি কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন কেউ জানিনা আমরা। পুলিশের নজর এড়িয়ে এই খবর আনা চাট্টিখানি কথা নয়!
ননী
তুমি ভেবো না অমর। ধরা পড়ব কেন? রামবাবুর পরিবার সেজে যদি যাই, মেয়েছেলেকে কেউ সন্দেহ করবে না বাবা
অমর
পিসি, তুমি ভেবে দেখ। রামচন্দ্রের স্ত্রী সেজে প্রেসিডেন্সি জেলে ঢোকা - এ কম কথা নয়। ওরা হাজারটা প্রশ্ন করবে, জমাদারনি ডাকিয়ে তোমাকে ভালো করে পরীক্ষা করবে। তুমি নিষ্ঠাবতী হিন্দু বিধবা-
ননী
আমার নিষ্ঠা, আমার থান যদি দেশের কাজে বাধা হয় তবে তা পায়ের তলায় ফেলে দিতে আমার বুক কাঁপবে না বাবা। তুমিই শিখিয়েছ আমাকে দেশের চেয়ে বড় কিছু নেই। না পরিবার, না ধর্ম, না ঈশ্বর। সবার আগে দেশ, সবার আগে স্বাধীনতা। যতীনবাবু যেমন বলতেন, পূর্ণ স্বাধীনতা। তোমাদের কত স্বপ্ন সে তো আমি জানি বাবা। আমিও যে স্বপ্ন দেখি, এ পোড়ার দেশের অভাগী মেয়েগুলোও স্বাধীন হবে, তারা পুরুষদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবে, সম্মান পাবে। মেয়েমানুষ না, তারা মানুষ হয়ে বাঁচবে।