ভূমিকা
"দেবদাসী সুতনুকা রূপদক্ষ দেবদিন্নকে কামনা করিয়াছিল"
সম্ভবত পৃথিবীর প্রাচীনতম প্রেমপত্র - ছত্তিসগড়ের যোগমারি গুহায় খোদিত হয়ে আছে আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে। কে সুতনুকা কে দেবদিন্ন, কোথা থেকে এসেছিল তারা, পালিভাষায় সত্যিই কী বলতে চেয়েছিল, ইতিহাস তা জানে না।
কেমন হয় যদি সুতনুকা আর দেবদিন্নের আদি সাকিন হয় আসলে বাংলাভূমি? কৈবর্ত, শূদ্রদের সে রাজত্ব বলকা দেবী, গঙ্গামায়ের দিব্যি দিয়ে বাইরের শত্তুরদের খেদিয়ে এসেছে এতদিন। তাদের বল্লমের নিশানা দেখে তফাত হয়েছেন আলেকজান্দার স্বয়ং। তাদের সোনার বাংলায় বাণিজ্যে ফসলে সমৃদ্ধিতে জ্বলজ্বল করছে চন্দ্রকেতুগড়। হয়ত এই আলেকজান্ডারের গঙ্গাহৃদি?
এই সব সারেগামা এসে কোথাও মিলবে আমাদেরই সামনে যোগশিরা গুহায়। সুতনুকা আর দেবদিন্নের ভালোবাসার শেষ অঙ্কে। গঙ্গাহৃদিপদ্মে।
নির্বাচিত চিত্রনাট্য
প্রাক-কথন
যোগী-মহেশ্বর এবং সীতা-বঙ্কিম দুইটি গুহা-মন্দির। ঘন অরণ্যাবৃত এই দুই মন্দিরে আদি বাল্মীকি এবং নির্বাসিতা সীতা স্বয়ং নাকি বাস করেছিলেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। মন্দিরের রুদ্রাণী জানেন শিবলিঙ্গের প্রোথিত অংশ বিস্তৃত হয়েছে অসূর্যমস্পশ্যা মহাপাতালে, মাতা বসুন্ধরার খাস ডেরায়। সেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে মহামূল্যবান গুপ্তধন সঞ্চিত আছে, এক নিষিদ্ধ রত্নের আকর। কত রথী মহারথী এসেছেন, আসবেন। কিন্তু মহাকালের এই গুপ্তধনের নাগাল কেউ পাননি, পাবেনও না। এই যেমন স্বয়ং আলেকজান্ডার। লোকমুখে প্রাচীন মন্দিরের প্রবাদ শুনে তিনি পরিকল্পনা করেছিলেন হস্তীবাহিনী নিয়ে আসবেন সেই রত্নভাণ্ডারের সন্ধানে। কিন্তু শতাধিক ক্রোশ দূরে পাটলিপুত্রের দূর্গদ্বার থেকে ফিরতে হল তাঁকে, পীড়িত অগ্ন্যাশয় এবং সমরবিমুখ সৈন্যবাহিনী নিয়ে।
হয়ত তিনি আসবেন আবার। নয়ত তাঁর কোনো সেনাপতি, বা আর কেউ? বীরভোগ্যা বসুন্ধরার কোনও রক্তপিপাসু সন্তান কি কখনও আসবেন মহাকালের সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে?
গুহামুখ থেকে সহস্র যোজন দূরে তখন ভয়ানক যুদ্ধ বেধেছে। নন্দরাজের আপন শ্যালক ভদ্দশালা লড়ছেন হাতি, ঘোড়া চতুরঙ্গ নিয়ে মোরিয়া উপজাতির এক অর্বাচীন দলপতির বিরুদ্ধে। ধূর্ত মোরিয়াপুত্ত কোথা থেকে বলশালী বাহিনী জোগাড় করেছে, সঙ্গে একদল ম্লেচ্ছ বর্বর যোদ্ধা। গ্রীক সেনা কেন এক মোরিয়াপুত্তের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে লড়বে? কোনো এক চন্দ্রগুপ্ত মোরিয়ার জয়ে কেন লাভবান হবেন সিকন্দর আলেকজান্দার?
সমরাঙ্গনে এর উত্তর খুঁজছেন ভদ্দশালা। আসুন, নবভারতের নতুন কুরুক্ষেত্র আমাদের জন্য প্রতীক্ষা করছে।
পর্ব এক - মোরিয়াপুত্ত
(ঘোড়ার খুরের শব্দ, বিশৃঙ্খলা, আর্তনাদ থেমে যায়)
রুফিয়াস
ডমিনিউস, ঘোড়াগুলো নিয়ে নীচে নেমে যাও, এগুলো যুদ্ধের ঘোড়া, কাজে দেবে।
ডমিনিউস
তিনজন বন্দী পেয়েছি। আজ সব মিলে বাইশ হল। মন্দ না। তবে, রুফিয়াস, জেন্দ্রাগুপ্তা আমাদের হিসেবের দাসগুলো নিয়ে নেবে না তো?
রুফিয়াস
জেন্দ্রাগুপ্তা এখন পাহাড়ে লুকিয়ে পড়েছেন, দাসের হিসেব কত করবেন আমার সন্দেহ আছে।
ডমিনিউস
বলছ? তা ভালো, আমার কতদিনের ইচ্ছে একটা ফোয়ারা লাগাব বাড়িতে, এবার বোধহয় - এই এই, দেখে, ইশ, বান্দাটার চোয়ালে মারলি পেরিয়ুস? দাঁত ভেঙে গেলে বেচতে পারব না মদ্দাটাকে। উফ, কি লোকসান।
রুফিয়াস
ভদ্দোসালা আরোও সেনা পাঠাতে পারে, সাবধানে যাও। আমি এগিয়ে দেখি জেন্দ্রাগুপ্তা কোথায় গেল।
ডমিনিউস
দেখ দেখ। জেন্দ্রাগুপ্তার কিছু হলে সেলুকাস সিধে সিকন্দরকে গিয়ে লাগাবে। আমি দেখি নীচে গ্রাম টাম পাই কিনা। দু'মাস ধরে বিছানায় কেবল ছেলে নিচ্ছি। মেয়েমানুষ চাই। বাদামী চামড়া হলেও চলবে।
রুফিয়াস
সাবধান ডমিনিউস, ভদ্দসালার হাতি সামনে যে গ্রাম পাবে গুঁড়িয়ে দেবে। জেন্দ্রাগুপ্তার অধিকাংশ সেনা দিশেহারা হয়ে পুব-দক্ষিণে গিয়েছে।
ডমিনিউস
অ। উঁচু থেকে দেখে নামব। হাতির মত ভারী বস্তু দিব্যি চোখে পড়বে। জেন্দ্রাগুপ্তা ভদ্দোসালা বাঁচিয়ে দেখি একটা বাঁদীও যদি পাই।
রুফিয়াস
জিউসের দিব্যি, এদেশের বাদামী মেয়েরা তোমার ঘোড়ীর মত নিরীহ না। অনেকে নাকি জাদু জানে। তোমাকে না ভেড়া করে রেখে দেয়। হা হা হা হা
(প্রতিধ্বনি)
ডমিনিউস
তেমন জাদুকরী কাউকে পেলে বোলো না হয়। জেন্দ্রাগুপ্তার সঙ্গে মাঝেমাঝেই একটা পালকি দেখি, ওতেও থাকতে পারে। বলা যায় না। চলি।
রুফিয়াস
হুম। ডমিনিউস বাচাল লোক, কিন্তু এই কথাটা মন্দ বলেনি। পালকি করে কে আসে কে যায় জেন্দ্রাগুপ্তা গোপন রাখেন। কাল রাতেও তাঁর শিবিরে পালকি ঢুকতে দেখেছি। আজ আমার হাজার নিষেধ সত্ত্বেও জেন্দ্রাগুপ্তা জেদ করলেন। ভদ্দশালার হাতির সংখ্যা বেশী, অথচ তীরন্দাজদের সামনে এগিয়ে দিলেন। হাতির পেছন থেকে তীরন্দাজ দিয়ে আমরা পুরুকেও রুখে দিয়েছিলাম, সেখানে…কে তাঁকে পরামর্শ দিল এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে?
আমি জেন্দ্রাগুপ্তা হলে ঐ ডানদিকের বাঁকে লুকোতাম, - ঝর্ণার আওয়াজ পাচ্ছি। এই পাথরের ওপর থেকে দেখলে বুঝতে পারব। ঐ তো জেন্দ্রাগুপ্তা, ঝর্ণার জল খাচ্ছেন। - এ কি। সর্বনাশ! এ যে বিশাল সিংহ! জেন্দ্রাগুপ্তার দিকে সোজা আসছে, আমার ভল্লের সীমানার বাইরে। এখন - এখন - একটাই উপায়।
(সিংহনাদ)
হীরাক্লিসের দিব্যি, পেরেছি!
চাণক্য
উত্তম। তুমি সিংহনাদ জান দেখছি। কোথায় শিখলে? সিকন্দরের কাছে?
রুফিয়াস
কে? সাবধান। কে আপনি? পরিচয় দিন নইলে গর্দান নেব।
চাণক্য
হাহা, কৌটিল্যের গর্দান কেন, কেশাগ্র স্পর্শ করার বুদ্ধিবল তোমায় আয়ত্তে নেই হে ম্লেচ্ছ বীর।
চন্দ্রগুপ্ত
গুরুদেব! রুফিয়াস! আমি সুরক্ষিত। অবতরণের পথ বড় বন্ধুর গুরুদেব, আপনারা ওখানেই অবস্থান করুন, আমি উঠে আসছি
রুফিয়াস
গুরুদেব! আপনিই তবে সেই রহস্যময় বিষ্ণুগুপ্ত? সেলুকাস বলেছিলেন আপনার কথা।
চাণক্য
কৌটিল্য বলে সম্বোধন কর অর্বাচীন ম্লেচ্ছ সৈনিক! বিষ্ণুগুপ্ত! আমার মাতা অবধি ও নাম বিস্মরণ হয়েছেন। তা তুমিই রুফিয়াস? সেলুকাস তোমাকে সেনাপতি করে পাঠিয়েছেন দেখছি।
চন্দ্রগুপ্ত-
প্রণাম গুরুদেব। রুফিয়াস, ধন্যবাদ বন্ধু। চমৎকার সিংহনাদ জান তুমি, প্রকৃত পশুরাজ চম্পট দিয়েছেন ও ডাক শুনে।
রুফিয়াস
আপনার সুরক্ষার দায়িত্ব স্বয়ং সেলুকাস আমায় দিয়েছেন। কিন্তু আপনি আজ অনাবশ্যক ঝুঁকি নিয়েছেন জেন্দ্রাগুপ্তা। ভদ্দসালার হস্তীবাহিনীকে সম্মুখ সমরে পরাজিত করা অসম্ভব।
চন্দ্রগুপ্ত
মগধের অধিকার পাওয়া সহজ কাজ নয় রুফিয়াস, কিছু অনাবশ্যক ঝুঁকি নিতেই হয়। গুরুদেব, আর্য্যমন্, কার্য সমাধা হয়েছে। পর্বতকের অধীনস্থ অন্তত তিনটি গ্রাম ভদ্দশালার বাহিনী ধ্বংস করে দিয়েছে।
রুফিয়াস
জেন্দ্রাগুপ্তা, এই কারণেই আপনি সর্বশক্তি নিয়ে আজ যুদ্ধ করেননি? কিন্তু পর্বতক এই যুদ্ধে ভদ্দসালাকে কোনও সাহায্য থেকে বিরত ছিলেন বলেই তো জানি।
চাণক্য
যুদ্ধে বিরত থাকা, আর যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে বিপক্ষ শক্তি হয়ে অংশগ্রহণের পার্থক্য বুঝতে শেখ হে সৈনিক।
এই নবান্ন তিথিতে পর্বতকের প্রিয় গোধূম শস্যক্ষেত্র লন্ডভন্ড করে দিয়েছে ভদ্দশালার বাহিনী। ধননন্দের ভ্রাতুষ্পুত্র এবার নন্দের শ্যালকের বিরূদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে দু'বার ভাববেন না।
চন্দ্রগুপ্ত, যোগী-মহেশ্বর গুহায় যাও, ঊর্ণনাভ অপেক্ষা করছেন।
চন্দ্রগুপ্ত
যথা আজ্ঞা গুরুদেব। যোগশিরা গুহার কথায় মনে পড়ল, গুরুদেব, এই রুফিয়াসই তার বাহিনী নিয়ে দস্যু দমনককে দলশুদ্ধ নিধন করেছে। সীতামন্দির থেকে লুণ্ঠিত রত্নসামগ্রীও আমাকে সমর্পন করেছে রুফিয়াস।
চাণক্য
জানি, জানি। দমনকের দল থেকে কেউ জীবিত আছে?
রুফিয়াস
না কৌটিল্যদেব। তরবারির আঘাতে তাদের সকলের মস্তক চূর্ণ করেছি।
চাণক্য
কোনো বন্দীকে দেখেছ? অন্ধ শীর্ণ কোনো বৃদ্ধ? দমনকের সঙ্গে ছিল?
রুফিয়াস
দাস দাসী আমরা কখনোই দস্যুদল থেকে সংগ্রহ করিনা কৌটিল্যদেব। রত্নসামগ্রী যা পেয়েছি জেন্দ্রাগুপ্তাকে সব দিয়েছি।
চাণক্য
সে সবই আমি দেখেছি। শোনো, আমার কাছে সংবাদ আছে দমনক সীতা-বঙ্কিম গুহা লুঠ করতে গিয়ে গুহাবন্দী এক অপরাধীকে হরণ করে নিয়ে যায়। অন্ধ, শীর্ণদেহ লোলচর্ম সেই অপরাধী যদি জীবিত থাকে তবে তার সন্ধান কর। আমার তাকে প্রয়োজন।
রুফিয়াস
যথা আজ্ঞা কৌটিল্যদেব। অপরাধীর কোনো নাম, বিশেষত্ব কিছু আছে?
চাণক্য
তার নাম দেবদিন্ন। তার দক্ষিণ হস্তের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠটি নেই, এবং সে দৃষ্টিহীন। দেখলেই চিনতে পারবে। তার সন্ধান পেলেই আমাকে সংবাদ দেবে। সে মৃত হলেও আমি জানতে চাই।
চন্দ্রগুপ্ত, এসো।
চন্দ্রগুপ্ত
যোগী-মহেশ্বর গুহা, অর্থাৎ, পর্বত অতিক্রম করতে হবে গুরুদেব? তাতে বিলম্ব হবে না?
চাণক্য
তুমি মগধের ভবিষ্যত রাজা, পর্বত তোমার সামনে নত হবে। ঐ নৈঋত কোণে ত্রিকোণ প্রস্তরখণ্ড আছে ওটি সরালে গুপ্তপথ পাবে। দুই প্রহরের মধ্যে গুহায় পৌঁছে যাব। ম্লেচ্ছ সৈনিক, দেবদিন্নর সন্ধান পেলে সত্বর যোগশিরার গুহায় চলে আসবে।
রুফিয়াস
আমি তবে বাহিনীকে উপযুক্ত নির্দেশ দিয়ে দেবদিন্নের সন্ধান জারি রাখি।
চন্দ্রগুপ্ত
বেশ। আর, রুফিয়াস, গুরুদেব সম্পর্কে তোমার অনুচরদের কাউকে কিছু না বলাই সমীচীন হবে।
রুফিয়াস
অবশ্যই। সিকন্দর বলেন অতিরিক্ত কৌতূহল প্রাণের মেয়াদ কমিয়ে দেয়।
চাণক্য
তোমাকে তাহলে যতটা মূর্খ ভেবেছিলাম ততটা তুমি নও হে ম্লেচ্ছ সৈনিক। হাহাহা। চল মৌর্যপুত্র, বিলম্বে বিপদ।
রুফিয়াস
বিদায় জেন্দ্রাগুপ্তা, শীঘ্রই দেখা হবে।
(ঘোড়ার খুরের শব্দ ফেড আউট)
(বাঁশি)
(ঘোড়ার খুরের শব্দ ফেড ইন)
রুফিয়াস
ভিক্ষুক? ভিক্ষুক? ভয় নেই। খাবার এনেছি।
দেবদিন্ন
কে? কে? ওহ, বিদেশী। আমি ভাবলাম এই অন্ধ ভিখারীকে কে ডাকতে এল।
রুফিয়াস
এই ভাঙা পাথরের মূর্তির সামনে বসে কী করছ?
দেবদিন্ন
এই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল তো, মনে হল কে যেন বাঁশি বাজাচ্ছে। কত দিন মেঘমল্লার শুনিনি। এই ভাঙা মূর্তিটার কাছে দুদণ্ড বসলাম। এই বাঁশিটা পড়েছিল। বাজাচ্ছিলাম।
রুফিয়াস
বাঁশি রাখ। ঘোর যুদ্ধ লেগেছে, বুঝলে ভিক্ষুক? এই নাও, মৃগমাংস এনেছি, খেয়ে নাও। দেহে বল পাবে।
দেবদিন্ন
ঐ দেখ, আমি ফল খেয়ে দিব্যি আছি, আবার মাংস টাংস কি দরকার। তুমি খাওগে ও সব। একেই কাঁচা মাংস আমি খেতে পারিনে।
রুফিয়াস
একসঙ্গে খাবো ভাবলাম। কেবল ফল খেয়ে গায়ে জোর পাবে? গুহা থেকে কখনও তো তোমায় বেরোতেই হবে। এই হরিণের চামড়াটা তুমি রাখ, রাতে যা শীত, তোমার প্রাণ বেরিয়ে যাবে নইলে।
দেবদিন্ন
আচ্ছা বিদেশী, আমাকে তুমি চেনো না, কখনও দেখনি আগে। তুমি এখানকার লোকই নও। অথচ তাও রামগিরির কুখ্যাত দস্যুদল নিধন করে আমাকে উদ্ধার করলে। তোমরা নাকি দাস দাসী করে এদেশের মানুষ নিয়ে গিয়ে বেচে দাও। তাহলে আমাকে এখানে লুকিয়ে রেখে এত যত্ন আত্তি করছ যে? সত্যিই কিন্তু আমার দেওয়ার মত কিছুই নেই তোমাকে।
রুফিয়াস
আমি খেতে খেতে তোমাকে কয়টা প্রশ্ন করছি, উত্তর দাও। তাতেই ঢের কাজ হবে।
তোমার দেশ কোথায়? কী নাম তোমার? মনে পড়েছে কিছু?
দেবদিন্ন
সে সব বলা বারণ আছে। তোমার জানলে বরং বিপদ।
রুফিয়াস
হীরাক্লিসের দিব্যি বিপদের ভয় রুফিয়াস করেনা। তুমি মগধের রাজাকে ভয় পাচ্ছ? তোমার কাহিনী বল, ভয় নেই। তোমার কোনো অনিষ্ট আমি হতে দেব না।
আচ্ছা বেশ, আমি অনুমান করছি কিছুটা। তোমার হাত দেখে মনে হয় তুমি যৌবনে ভাস্কর ছিলে। তোমার দক্ষিণ হস্তের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ নেই। অর্থাৎ কোনো গর্হিত অপরাধে তুমি দণ্ডিত।
ঠিক?
দেবদিন্ন
বেশ, বেশ। আর বল, শুনি
রুফিয়াস
দমনক সীতা-বঙ্কিম গুহা লুঠ করেছিল। ধনরত্নের চেয়েও মূল্যবান বস্তু হরণ করেছিল বলে শোনা যায়।
দেবদিন্ন
বেশ। আর?
রুফিয়াস
বাকিটা হয় তুমি বল নয়তো তোমাকে নিয়েই সীতা-বঙ্কিম গুহায় যাব। প্রধান পুরোহিত অপেক্ষায় আছেন। তাঁর থেকেই তোমার কাহিনী শুনব না হয়?
দেবদিন্ন
(দীর্ঘশ্বাস ফেলে)
প্রাণের মায়া আমি আর করিনে। ঈশ্বর যতদিন বাঁচিয়ে রাখবেন তাই থাকব। দস্যু দমনক আমাকে হরণ করে এনে কত ধনরত্নের লোভ দেখিয়েছিল। সে তার কর্মফল পেয়েছে। ভেবেছিলাম এভাবেই দেবদিন্নের জীবন গাথা শেষ হয়ে যাবে। রামগিরির অজানা কন্দরে আমার হাড়গোড় শুকিয়ে থাকবে। কিন্তু তুমি শেষে আমাকে বিপদে ফেললে বিদেশী। ঔষধ পথ্য দিয়ে আমাকে সারিয়ে তুলে দেবদিন্নকে এই শেষ বয়সে ঋণী করে তুললে। তোমাকে ধর্মত আমি বিপন্ন করতে পারি না। তবে শোনো আমার কাহিনী।
আমি এ দেশের লোক নই। তুমি গঙ্গা নদী দেখেচ তো? ঐ নদী যেদেশে সাগরে মেশে আমি সেখানকার লোক।
রুফিয়াস
গঙ্গারিডি? তুমি গঙ্গারিডির লোক?
দেবদিন্ন
(হেসে)
বেশ নাম রেখেছ বিদেশী। গঙ্গাহৃদি। আমরা তাকে ডাকি বাংলাভূমি নামে। তোমার দেশ কেমন আমি জানিনে বিদেশী, কিন্তু সেদেশের রূপলাবণ্য যে না দেখেছে তার পক্ষে কল্পনা করা কঠিন। গঙ্গার তীরে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে তুলে আনতাম রূপোলি মাছ।
রুফিয়াস
তুমি জন্মান্ধ নও তাহলে। দেখতে পেতে তখন?
দেবদিন্ন
তা দেখতাম বৈ কি। এই যে আমার রোগা শরীর দেখছ, তখন ছিল যৌবনশক্তিতে ভরপুর। ষাঁড়াষাঁড়ির বান এলে নদীতে ঝাঁপিয়ে বান পেরোতুম, এ যেন এই সেদিনের কথা। খাবার সেখানে হাত বাড়ালেই মেলে, খুঁজতে হয়না। কলমীর বন, সজিনার ফুল, বাঁশের কোঁড়, মধুগুলগুলী আম, বিচে-কলা। সে দেশে কেউ না খেয়ে মরেনা, বুঝলে বিদেশী?
রুফিয়াস
তবে তুমি এদেশে এলে কেন?
দেবদিন্ন
আমি তো চাইনি আসতে। বাপ ছিল নামকরা রূপদক্ষ, মন্দিরের কারুকাজ করার জন্য দেশ বিদেশ থেকে তার ডাক আসত। আমি খেয়ালখুশি মত বাড়িতেই মূর্তি গড়তাম, দেশ ছাড়ার এতটুকু ইচ্ছে আমার ছিল না। একদিন বাপ এসে বলল চাঁদগড়ের রানী তলব করেছেন, জরুরী দরকার। বাপবেটায় গেলাম চন্দ্রকেতুগড়। রানী বললেন মগধের রাজা বিশেষ অনুরোধ করেছেন কারিগর চেয়ে। বাপের শরীর ভালো ছিল না, অগত্যা আমিই চলে এলাম। সেই শেষ। দেশে আমার আর ফেরা হয়নি।
রুফিয়াস
মগধের রাজা তোমার আঙুল কাটল কেন? কী অপরাধ করেছিলে?
দেবদিন্ন
মগধের রাজা আমার আঙুল কাটেনি তো। আমি নিজে কেটেছি।
রুফিয়াস
নিজেই নিজের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ কেটে ফেললে? কেন?
দেবদিন্ন
(বিষণ্ণ হেসে) কথা দিয়েছিলাম। যাকে ভালোবাসি, তাকে কথা দিয়েছিলাম মূর্তি আমি আর গড়ব না। আত্মহত্যা মহাপাপ, তাই দেবদিন্ন বেঁচে থাকবে। কিন্তু রূপদক্ষ মরে যাবে চিরকালের জন্য। কথা দিয়েছিলাম। তাই কথা রাখলাম।
রুফিয়াস
ভালোবেসেছিলে? সর্বনাশ! রাজকন্যা রাজত্ব চেয়ে বসেছিলে নাকি?
দেবদিন্ন
আমি তো কিছুই চাইনি। সেই এসেছিল আমার কাছে - রাজকন্যা নয়, তবে তার মত রূপ আমি আর দেখিনি।
রুফিয়াস
তবে তোমার অপরাধ?
দেবদিন্ন
সে আমায় চেয়েছিল, আমি তাকে ফেরাতে পারিনি। এই অপরাধ। মন্দিরের দেবদাসী রূদ্রাণী ছিল সে। তাকে দেখে মূর্তি বানানো যায়, ছোঁয়া যায় না।
রুফিয়াস
নিষিদ্ধ প্রেম করলে গর্দান যাবার কথা। তুমি এতদিন বন্দী ছিলে কেন?
দেবদিন্ন
(দীর্ঘশ্বাস ফেলে)
তুমি বুদ্ধিমান বিদেশী। যোগী-মহেশ্বর গুহার এক ভয়ানক রহস্য আমি জানি। এক গুপ্তদ্বারের হদিস, আমি জানি। কেবল আমিই তা জানি। যাতে আর কেউ না জানতে পারে তাই স্বেচ্ছায় নিজের চোখ উপড়ে ফেলেছি, আঙুল কেটে ফেলেছি। তাও আমাকে বন্দী করলেন প্রধান পুরোহিত। প্রতিদিন এসে জানতে চাইতেন গুপ্তদ্বারের কথা। আমাকে প্রাণে মারলেন না।
রুফিয়াস
দমনকও জানতে চেয়েছিল?
দেবদিন্ন
দমনক লোভী কীট। সে সীতামায়ের মাথার মণির লোভে আমায় অপহরণ করেছিল। তার কর্মফল সে পেয়েছে।
রুফিয়াস
বেশ। তোমাকে গোপনে উদ্ধার করে ভালোই হয়েছে। অনেক চোখ কান তোমায় খুঁজছে। কটাদিন এখানেই থাক। তারপরে দেখা যাবে।
দেবদিন্ন
সাবধান বিদেশী। পুরোহিত ঊর্ণনাভ একবার যদি জানতে পারেন তোমার প্রাণ-সংশয় হবে। আমার কথা কাউকে জানিও না।
রুফিয়াস
আমি সিকন্দরের পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছি দেবদিন্ন। আমার প্রাণ-সংশয় করতে পারে এমন বস্তু দুনিয়ায় কম আছে। সাবধানে থেকো। আর এই শিঙাটা রাখ। যদি কখনও বিপদে পড় এই শিঙা বাজাবে। এটা হারিও না, দেবী এথেনার মন্দিরের জিনিস এ। চলি।
দেবদিন্ন
বিদেশী, তোমার নাম বলে গেলে না?
রুফিয়াস
আমি? সিকন্দর, মহান আলেকজান্দারের সৈনিক আমি, সেলুকাসের অধীন, ম্যাসিডোনীয়ার রুফিয়াস।
পাঠ
প্রাচীন ভারতের ইতিহাস লিপি হয়ে পুঁথিতে ওঠার আগে গান হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে মানুষের মুখে মুখে। ছবি হয়ে ফুটে উঠেছে দেবালয়ে, গুহাপ্রান্তরে। তাই গ্রীক ঐতিহাসিক যখন লিখছেন আলেকজান্ডার কোন এক গঙ্গারিডির সৈন্য, হাতিঘোড়া দেখে পাটলিপুত্র থেকে পিছু হটেছিলেন, আমরা অবাক হয়ে ভাবি এ নাম এল কোথা থেকে? গাঙ্গেয় উপত্যকার একচ্ছত্র সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আগে কেউ হয়ে ওঠেননি। তাহলে গঙ্গারিডি কোথায়? কে তার রাজা? রাজাই ছিল, না রাণী? এবার মগধ থেকে আসুন পাতালে। পুরাণে যাকে পাতাল বলে সেই পূর্ব ভারতে, গঙ্গার তীর ধরে নেমে আসুন সমতলে। বাণিজ্যে ফসলে সোনার বাংলায় জ্বলজ্বল করছে চন্দ্রকেতুগড়। হয়ত এই আলেকজান্ডারের গঙ্গাহৃদি? প্রশ্ন থেকে যায়, রামায়ণের সীতা বসুন্ধরার কোলে সমর্পণ করেন নিজেকে, তাঁর সেই পাতালপ্রবেশ কোথাও কি এই বাংলায় এসে মিলে যায়? মাটির মেয়ে তিনি, রত্নাকরের আশ্রয়ে তাঁর নির্বাসন দণ্ড কেটেছে অরণ্যের গভীরে, নিমিত্ত হয়েছেন রাম রাবণের মহাযুদ্ধের। অথচ পাতালকন্যার কাহিনিতে খনিজ উত্তোলনের গল্প কেন কোথাও শোনা যায় না? তামা থেকে ব্রোঞ্জ, ব্রোঞ্জ থেকে লোহার যুগে পা দিল জম্বুদ্বীপ, অথচ শিল্পে, সাহিত্যে, গানে কোথায় সেই খনিমজুরদের কথা?
হয়ত আছে সামনেই, আমরাই বুঝতে পারিনা। যোগশিরার গর্ভগৃহে যাওয়া যাক। পুরোহিত ঊর্ণনাভ দুই অতিথিকে নিয়ে কোন পরামর্শে বসলেন?
পর্ব দুই - গর্ভগৃহ
ঊর্ণনাভ
কৌটিল্যদেব, আপনি উতলা হবেন না। মগধের চারদিকে চর ছড়িয়ে আছে। একটা অন্ধ খঞ্জ ভিক্ষুককে তারা খুঁজে পাবে না এ অসম্ভব। আর খবর প্রকাশ হবার ঝুঁকিও নেই বললেই চলে। সে আজ অবধি একবারও গুপ্তদ্বারের কথা বলেনি কাউকে। কতবার জিজ্ঞাসা করেছি! সে আমাকেও ফিরিয়ে দিয়েছে।
চাণক্য
নগরে ম্লেচ্ছ সৈন্য কম নেই। একটিকে তো স্বচক্ষে দেখলাম আজ। যেমন চতুর, তেমন রণনিপুণ। সাবধানের মার নেই। জীবিত বা মৃত, দেবদিন্নকে খুঁজে বার কর। চন্দ্রকেতুগড় থেকে কোনো সংবাদ?
ঊর্ণনাভ
রাণী মহামায়ার প্রয়াণের পরে তাঁরা বিশেষ যোগাযোগ রাখেন না। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম দস্যু দমনককে বুঝি ওরাই প্রেরণ করেছে। কিন্তু না, দমনক লুঠপাট করতেই এসেছিল। দেবদাসীদের ভাগ্যি অবরোধে রেখেছিলাম, মহেশ্বরের ইচ্ছায় গর্ভস্রাবগুলো তাদের স্পর্শ করতে পারেনি।
চাণক্য
অথচ দেবদাসী সুতনুকা এই যোগী-মহেশ্বর মন্দির থেকেই অন্তর্হিত হয়ে যায়, আপনার সহস্রচক্ষুও তার হদিশ পায়নি এত বৎসরে।
ঊর্ণনাভ
ঐ এক কুলটা। সুতনুকা। সেই দেবদিন্ন, কোথায় যে তাকে লুকিয়ে ফেলল! সুদূর চন্দ্রকেতুগড় অবধি চর পাঠিয়েছি কতবার, এই ধননন্দ আসার পর থেকে আর পারিনি অবশ্য. তাকে পেলে আমি - কিন্তু কিন্তু- দেব সে তো পঞ্চাশ বৎসর পূর্বের ঘটনা। আপনি এ কথা -
চাণক্য
আমি জ্ঞাত নই এমন বিষয় এই দেবভূমিতে কম আছে ঊর্ণনাভ। সুতনুকা জানত পাতালগুহার রহস্যের কথা?
ঊর্ণনাভ
আমার অনুমান ঐ গর্ভস্রাব দেবদিন্নের সঙ্গে প্রণয়কালে তাদের মধ্যে কিছু কিছু কথা হয়েছিল। কিন্তু গর্ভগৃহে তারা কখনও একত্রে প্রবেশ করেনি -
চন্দ্রগুপ্ত
ক্ষমা করবেন দেব, কী এই রহস্য যা এক রূপদক্ষ এবং দেবদাসী ভিন্ন আর কেউ জ্ঞাত নয়? আমার বড় কৌতূহল হচ্ছে।
চাণক্য
আমি বলছি, যদি ভুল কিছু বলি ঊর্ণনাভ জানাবেন। বৎস চন্দ্রগুপ্ত, এই গুহাটি ভালো করে পর্যবেক্ষণ কর। বহু প্রাচীন এই মন্দিরে ছিল বাল্মীকির বাস। পাশে এর যমক গুহাটি সীতাদেবীর নামে, তাঁর নির্বাসন এখানেই কেটেছিল। তক্ষশিলায় পুরাণের কিছু লুপ্ত অপ্রচলিত সূত্র পাঠ করে আমার ধারণা হয় শুধু মন্দির নয়, এই গুহায়, এই পর্বতের গর্ভে রয়েছে বহু খনিজ সম্পদের আকর। তার সন্ধান যোগ্য ব্যক্তি পেলে এমন অস্ত্র, এমন কোদন্ড, এমন লাঙ্গল সে বানাতে পারবে যাতে সসাগরা পৃথিবীর অধীশ্বর হওয়া যায়। সৈন্য, খাদ্য, অর্থ, কখনও কোনো অভাব তার থাকবে না।
কিন্তু শিবলিঙ্গের মন্দিরে খননকার্য শাস্ত্রবিরোধী। প্রশ্ন হচ্ছে এই শিবলিঙ্গের স্থাপনা এখানে কে করলেন? পুরাণে এর খোঁজ আমি পাইনি। আমার ধারণা এই কাজ চন্দ্রকেতুগড়ের প্রেরিত শৈব সন্ন্যাসীদের। এই মন্দিরের সঙ্গে তাদের যোগাযোগও বহু প্রাচীন।
চন্দ্রগুপ্ত
হয়ত তাঁরা শৈবধর্ম প্রচারের জন্যই তা করেছেন? খনিজ উত্তোলনের সম্ভাবনা তাঁরা জানতেন না?
চাণক্য
তা সম্ভব। কিন্তু অপর দিকে দুটি সমান্তরাল সূত্র থেকে যায়, যাদের শেষপ্রান্ত কালগর্ভে লীন হয়ে গিয়েছে। প্রথমতঃ, খনির এই পুরাণকথিত বিস্তার যদি সত্যই সমতট অবধি হয়ে থাকে, তবে গাঙ্গেয় উপত্যকার হৃদয়ে রয়েছে এই রত্নভাণ্ডারের সিংহভাগ।
চন্দ্রগুপ্ত
ম্লেচ্ছ সেনা না জেনেই ভূমির নাম দিয়েছে গঙ্গাহৃদি। অতএব চন্দ্রকেতুগড় যতকাল না মগধ অধিকার করছে তারা এই খনির অধিকার না ত্যাগ করতে পারে না স্বীকার করতে পারে।
চাণক্য
দ্বিতীয়ত, এই চন্দ্রকেতুগড় বৈশ্য, শূদ্রদের রাজত্ব, মূর্খের দল বেদবিধি মান্য করে না, তারা মাতৃপূজক। গঙ্গা নদী নিয়ে তারা অতি-সংবেদনশীল। তারা নদীকে মাতৃজ্ঞানে পূজা করে।
ঊর্ণনাভ
শুধু কি তাই? গর্ভস্রাব নাকি তাদের এক মেয়েছেলেদের গুপ্তসমিতি আছে, তার নাম গঙ্গাজল। ঐ কুলটা সুতনুকা সেখান থেকেই এসেছিল, পাতালপ্রবেশের দ্বারের সন্ধানে। ঐ গর্ভস্রাব দেবদিন্ন ঐ দেশেরই লোক, যখন এনেছিলাম তখন কি জানতাম কী কালসর্প পুষেছি?
মহেশ্বরের করুণায় এক একটার গঙ্গাপ্রাপ্তি হোক। মরুক, মরুক। অতিসার, ওলাউঠো হয়ে মরুক সব।
চাণক্য
মহর্ষি ঊর্ণনাভ এর শাপ যতক্ষণ গুপ্তসমিতিকে বধ করছে, সীতার পাতালপ্রবেশের একটি অপ্রচলিত ব্যাখ্যা বলি, রামচন্দ্রের বাণে সরস্বতী নদী শুকিয়ে যেতে সীতা রুষ্ট হন, পরে রামরাবণের যুদ্ধের ধ্বংসলীলায় ভীত হয়ে তিনি স্বেচ্ছায় পাতালপ্রবেশ করেন পূর্ব ভারতের নদীগুলিকে রক্ষা করার ব্রত নিয়ে। পাতালকন্যা হওয়ার কারণে সেই দৈব শক্তি তাঁর ছিল।
চন্দ্রগুপ্ত
খনিজ উত্তোলনের ফলে নদী অববাহিকার ক্ষতি হতে পারত কি? সীতাদেবী হয়ত অনুধাবন করেছিলেন -
ঊর্ণনাভ
সীতামায়ের কি আর অত জ্ঞান থাকে। হাজার হলেও স্ত্রীলোক-
চাণক্য
হতেই পারে তিনি জানতেন অধিক খনিজ উত্তোলনের ফলে প্রাচীর ভেদ করে জল উঠে আসে। অববাহিকায় বেশ কিছু খাদ বা হৃদ সৃষ্টি হতেই পারে। এমনকি স্রোতমুখ বদলেও যেতে পারে। কিন্তু, ভবিষ্যতে ঊর্ণনাভের ধারণাই প্রতিষ্ঠা করতে হবে। স্ত্রীলোক রাজনীতির সিদ্ধান্ত নিচ্ছে এমন কথা জনসমক্ষে না আসাই শ্রেয়। চন্দ্রগুপ্ত। তুমি নিছক মগধের রাজা হবে না। আমি ভবিষ্যদ্বাণী করছি তুমি রাজচক্রবর্তী সম্রাট হবে। রামায়ণ গান তোমার এবং তোমার সন্ততিদের অনুগ্রহে লিপিবদ্ধ হয়ে প্রচারিত হবে। তখন কোনওভাবেই এই অপ্রচলিত সূত্রগুলি যেন গ্রাহ্য না হয়। রামচন্দ্রের রাজধর্ম পালনের নিমিত্ত সীতার পাতালপ্রবেশের কাহিনীর অন্যথা যেন না হয়।
চন্দ্রগুপ্ত
তাই হবে আয়ুষ্মন। কিন্তু সেই রূপদক্ষ দেবদিন্ন একা কীভাবে এই রহস্য উদ্ঘাটন করল?
চাণক্য
ঊর্ণনাভ গুহার প্রাচীন মূর্তিগুলি সংস্কারের নিমিত্ত চন্দ্রকেতুগড় থেকে রূপদক্ষ নিয়ে আসেন। নবীন রূপদক্ষ সুদর্শন, গণিতে অসম্ভব পারদর্শী। মূর্তি সংস্কারের পাশাপাশি গুহাপ্রাচীরের নানারকম পরিমাপ নিয়ে সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মহর্ষি ঊর্ণনাভ যোগনিদ্রায় ছিলেন, তাঁর কোনও সন্দেহ হয়নি। শেষে রূপদক্ষ একরাত্রে স্বয়ং এসে তাঁকে জানায় - ঊর্ণনাভ, আপনি বলুন
ঊর্ণনাভ
সে রাত্রির কথা স্পষ্ট মনে আছে। আমি রাতের পূজা সমাপন করে বিশ্রাম করছি, দেবদিন্ন দ্বারে ঘা দিল। উঠে দেখি তার উস্কোখুস্কো চেহারা, চোখে অমানুষিক দ্যুতি। সে আমার সামনে খড়ি দিয়ে মেঝেতে ত্রিকোণমিতি এঁকে ব্যাখ্যা করল এই গর্ভগৃহের নীচে অনেকটা ফাঁপা। তার প্রবেশদ্বারের সন্ধান সে পেয়েছে। আমি যদি সম্মতি দিই প্রবেশদ্বার খোলার চেষ্টা করবে। মন্দিরের পাতালগুহার প্রাচীন জনশ্রুতি আমি জানতাম। তাকে বললাম খননকার্য শাস্ত্রবিরুদ্ধ। সে যদি বিনা খননে দ্বার উদ্ঘাটন করতে পারে, তবেই আমি সম্মত আছি।
চন্দ্রগুপ্ত
প্রবেশদ্বার কোথায় সে বলেনি?
ঊর্ণনাভ
না। তার পূর্বে কক্ষে নির্বসনা দেবদাসী সুতনুকাকে দেখে সে লজ্জিত হয়ে পরে আসবে বলে। আমিও নিদ্রাবেশে অত খেয়াল করিনি। ঐ কালনাগিনী যে পরদিন থেকে দেবদিন্নের কানে মন্তর দিয়েছে বুঝতে পারিনি। সকাল হতে দেবদিন্নকে ডেকে পাঠালাম, রাতের উত্তেজনা শান্ত হয়েছে, তাকে যেন চিন্তিত মনে হল। সে অসংলগ্ন ভাবে জানিয়ে গেল গণিতের কিছু ভুল হয়েছে, প্রবেশদ্বার আদৌ সে পায়নি। দিনকয়েকের মধ্যে দেখলাম দেবদিন্ন আর আগের মত কাজে সময় দেয় না। সুতনুকার সঙ্গে তার প্রণয়ের সংবাদ আমার গোচর হল। আমি সুতনুকাকে বন্দী করলাম। পরদিনই সুতনুকা দেবদিন্ন দুজনেই মন্দির থেকে উধাও। চর-মাধ্যমে জানলাম সেই মেয়েছেলেদের গুপ্তসমিতি গঙ্গাজল? দেবদাসী সুতনুকা তাদের সদস্যা ছিল।
পুরো ঘটনা আমার কাছে স্বচ্ছ হয়ে এল।
চন্দ্রগুপ্ত
তারপরে আর তাদের দেখতে পাননি?
ঊর্ণনাভ
দেবদিন্ন ফিরে এসেছিল। পঙ্গু হাত, অন্ধ দৃষ্টি নিয়ে। গুপ্তসমিতি চায়নি মগধের রাজা চণ্ড পাতালগুহার সন্ধান পাক। তাকে কত অত্যাচার করেছি, মিষ্ট কথায় বুঝিয়েছি। একটি শব্দও উদ্ধার করতে পারিনি।
চন্দ্রগুপ্ত
আপনাকে যখন যে কিছু জানায়নি,হয়ত কাউকেই কিছু জানাবে না। এতদিনে সে অশীতিপর বৃদ্ধ
চাণক্য
এমন ওষধি লতা আছে যার ঘ্রাণে মানুষ মস্তিষ্কে
নিয়ন্ত্রণ হারায়। মলমূত্রত্যাগ বুঝতে পারে না, খাদ্য পানীয়ের স্বাদ বুঝতে পারে না। প্রশ্নের উত্তরে সত্য বলতে থাকে কেবল, মিথ্যা বানিয়ে বলার ক্ষমতা থাকে না। দেবদিন্নের ওপর এই ওষধি আমি প্রয়োগ করে দেখতে চাই।
চন্দ্রগুপ্ত
হয়ত সে আর বাঁচবে না, তাতে কিছু আসে যায় না। রাজ্যের স্বার্থ আগে।
চাণক্য
তার বেঁচে থাকার কোনো প্রয়োজন দেখি না। স্মরণ কর, তোমার ক্ষুন্নিবৃত্তি করতে ব্রাহ্মণের অন্ত্র কেটে তোমায় খাদ্য সংগ্রহ করে দিয়েছি চন্দ্রগুপ্ত
ঊর্ণনাভ
মহাদেব, মহেশ্বর - রক্ষা কর
চাণক্য
এমন অতুল রত্নভাণ্ডারের সন্ধান পেতে একটা বৃদ্ধ শূদ্রসন্তানকে হত্যা করা কি এমন কঠিন কাজ? ধাতুর অঢেল ব্যবস্থা থাকলে সেনা, রাজকোষ কখনও দুর্বল হবে না।
চন্দ্রগুপ্ত
আপনার আজ্ঞা শিরোধার্য আয়ুষ্মন।
চাণক্য
চন্দ্রকেতুগড়ের একটি প্রচলিত গান আছে, তাদের পূজার পাঁচালি। সেখানে যোগশিরার উল্লেখ আছে। প্রথমে শুনলে নিম্নশ্রেণীর নিম্নবর্ণের প্রমোদ ভিন্ন তার কোনো অর্থ পাওয়া যায় না। কিন্তু বার বার শুনলে মনে হয় গানটি একটি সংকেত। ভরণী নক্ষত্রের কোনো বিশেষ দশায় ত্রয়োদশী তিথিতে গুপ্তদ্বার উদ্ঘাটন হয়, এমন সূত্র পাওয়া যায়। এখন ভরণীর রাহুদশার অন্তিম কাল। আজ দ্বাদশী।
ঊর্ণনাভ
মহেশ্বরের ইচ্ছেয় যদি রত্নভাণ্ডারের হদিশ পাই, ঐ নন্দরাজকে বুঝিয়ে দেব। অর্থগৃধ্নু পরামাণিকের দল কম দোহন করেছে আমাকে, এই দেবালয়কে?
চাণক্য
গুপ্তধন সম্পর্কে আপনি নীরব থাকবেন পুরোহিত ঊর্ণনাভ। নতুবা -
ঊর্ণনাভ
মহেশ্বরের ইচ্ছেয় - নতুবা, কী হবে?
চন্দ্রগুপ্ত
আপনার প্রাণ সংশয় হতে পারে দেব।
ঊর্ণনাভ
একি, তরবারি কেন? মহাকাল সহায়, আমি কাউকে কিছুই জানাব না।
চন্দ্রগুপ্ত
তাতেই আপনার মঙ্গল।
পরবর্তী অংশ শুনুন ইউটিউবে
তথ্যসূত্র
বই
- নারায়ণ সান্যাল. সুতনুকা একটি দেবদাসীর নাম
- বিষ্ণু দে. ঘোড়সওয়ার
- অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর. প্রাচীন বাংলার ছড়া
- শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ. গঙ্গাহৃদি
- Upinder Singh. Political Violence in Ancient India