ভূমিকা
আসিফা ফেরারী জীবনের শেষ রাতে জ্বরের ঘোরে এক তেঁতুল গাছের সঙ্গে গল্প করছিল। সে গল্পে দেবদাস আছে, বিদ্যাপতি আছেন, রবীন্দ্রসঙ্গীত আছে, আর আছে এক প্রেমের গল্প - তোমাকে চাই। সেসব নিয়েই শ্রুতিনাটক শুধু তোমার জন্য, আসিফা ট্রিলজির দ্বিতীয় অংশ।এর শুরুতে আছে শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাস দেবদাস অবলম্বনে শ্রুতিনাটক দেবদাস পাঠ অভিনয়। আর ক্লাইম্যাক্সে আছে ও’হেনরীর “A Service of Love” গল্পের ছায়া অবলম্বনে নির্মিত শ্রুতিনাটক “তোমাকে চাই।”
“A Service of Love” মিষ্টি একটা প্রেমের গল্প। মধ্যবিত্ত জো আর ডেলিয়া আমেরিকার সেকেলে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে প্রেমটা বজায় রেখে যায়। ও’হেনরী যখন গল্প লিখেছেন আমেরিকায় সরকারিভাবে সমকামী সম্পর্কের জন্য বরাদ্দ ছিল পাগলের চিকিৎসা। তাঁর জো আর ডেলিয়া স্ট্রেট কাপল। কিন্তু এই শ্রুতিনাটকে জয় আর ডালিয়া দুজনেই তো মেয়ে, জয়তী নিজেকে যতই জয় বলুক, সমাজ তাকে চেনে জয়তী বলেই। সে সমাজের ভ্যালিডেশনের মুখে ছাই দিয়ে জয় আর ডালিয়ার সার্ভিস অফ লাভ - “তোমাকে চাই”। এখানে নাটকের অংশবিশেষ রইল সংলাপ আকারে।
নির্বাচিত চিত্রনাট্য
নাটক - তোমাকে চাই
দৃশ্য এক (হাসপাতালের আবহ)
ডালিয়া মিত্রর বাড়ির লোক কে আছেন?
আমি -
আপনি? কে হন আপনি?
আমি - আমি, - ডালিয়া কেমন আছে?
ডঃ লাহিড়ী কথা বলবেন। আইসিইউর সামনে চলে যান।
**********************************************
আমি ডালিয়ার বাড়ির লোক। ম্যাডাম, একটু বলবেন ও কেমন আছে?
ডঃ লাহিড়ী - দেখুন ওনার সেপসিসটা একটু খারাপ দিকে যাচ্ছে। প্রথম দিকে পোড়া জায়গাগুলো ভালোই শুকিয়ে আসছিল। হঠাৎ করেই, কাল রাত থেকে অন্যরকম দেখছি। আসলে বার্ন ইনজুরিগুলো একটু -
দিদি, ও বাঁচবে তো?
ডঃ - আমরা চেষ্টা করছি, উই আর ট্রাইং আওয়ার বেস্ট। আসলে কোমা সেট ইন করে যাচ্ছে
কোমা!
ডঃ - হয়ত ভেন্টিলেটরে দিতে হতে পারে, বন্ড সই করতে হবে। আপনিই -?
দিদি, ও বাঁচবে তো?
ডঃ- উই শ্যাল ট্রাই আওয়ার বেস্ট। আচ্ছা, আপনি কে হন ওনার?
আমি - আমি-
ডঃ - বোন? দিদি?
আমি -
ডঃ - কে হন?
আ - আমি, আমি ওকে ভালোবাসি দিদি। ডালিয়া বাঁচবে তো?
ডঃ- উনিও আপনাকে -
ভালোবাসে, আমাকে পাগলের মত ভালোবাসে দিদি, আমিই বলিনি কখনও, কেন বলিনি…
ডঃ- এখন বলুন।
বলব দিদি। ওর হুঁশ ফিরুক, বলব। ফিরলেই …
ডঃ - এখনই বলুন। ভেতরে যান। যা উনি শুনতে চান, জোরে জোরে বলুন সেই সব কথা। জোরে জোরে ওনার নাম ধরে ডাকুন।
আইসিইউতে জোরে জোরে কথা বলব?
ডঃ- বলবেন। কোমা পুরোপুরি ওনাকে নিয়ে নেবার আগে ওনাকে ফেরাতে হবে। আমরা আমাদের মত চেষ্টা করছি। আপনিও করুন। ভেতরে যান।
*********************************************
জয়
ডালিয়া, ডালিয়া? ও ডালিয়া? একবার বল আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস? ও রাক্ষুসী, একবার কথা বল আমার সঙ্গে? ডালিয়া, ডালিয়া? আমি তোর জয়, দেখ আমি সকাল থেকে কিচ্ছু খাইনি। তোকে বাড়ি নিয়ে যাব, তবে খেতে বসব। দুজনে মিলে না বসলে কি খাওয়া হয়, বল ডালিয়া? তোর অত পছন্দের খাবার টেবিলটা বেচে দিয়েছি, মাটিতে বসে খেতে হবে কিন্তু। ভালোই হল, খেয়েদেয়ে তুই ওখানেই রেওয়াজে বসবি, অতটুকু ফ্ল্যাটে আর টেবিল সরানো….ও ডালিয়া? শুনছিস তো আমার কথা? আমি নতুন গান লিখছি ডালিয়া, তুই গাইবি তো? তুই ছাড়া কে গাইবে বল? ও ডালিয়া, আমরা মিছিলে হাঁটব একসঙ্গে, তুই গাইবি গান, জানিস তো আমি গাইতে পারি না, আমার একহাতে থাকবে পোস্টার, আরেক হাতে তোর হাত। ডালিয়া, ডালিয়া, এখনও লড়াই বাকি, কত লড়াই বাকি আমাদের, বল ডালিয়া? ডালিয়া, মনে পড়ে, প্রথম যেদিন তোকে নিয়ে এলাম হষ্টেল থেকে আমার কাছে? ওখানে তোর জুয়াড়ি বর এসে উৎপাত করত, তুই মুখ বুজে সহ্য করতিস। বোকা মেয়ে, একবারের জন্য জয়কে বললে কী হত? এই প্রশ্নটা যেদিন করেছিলাম, মনে আছে কী বলেছিলি?
দৃশ্য দুই (ফ্ল্যাশব্যাক)
ডালিয়া -
উফ, তুই রাগলে কেমন যেন পাগলা হয়ে যাস। তারপরে একটা খুনোখুনি হয়ে যাক। তাই তো বলিনি। আর তাছাড়া সুরেশের উৎপাত আজ নতুন নয়, বরং এখন ও বড় সুযোগ পেয়ে ওঠে না -
জয় - একবার নাগালে পেলে দেখিয়ে দিতাম সুযোগ কাকে বলে। তোর গায়ে হাত তোলে, এত সাহস? ওর হাত, পা সব ভাঙব, যে ঘাড়ে মাথা নিয়ে তোকে কষ্ট দিয়েছে সেই ঘাড় আমি মটকে দেব।
ডালিয়া - তাই তো। ঐ লিকপিকে চেহারা, লো প্রেশার নিয়ে বীরত্বের শেষ নেই দেখি। অ্যাই এদিকে আয়।
জয় - বিশ্বাস হচ্ছে না তো? ভাবছিস মুখে বড় বড় বাতচিত? সুরেশের অফিসটা ধর্মতলায় না? দাঁড়া…
ডালিয়া - আমার ভালো লাগছে না কিন্তু জয়। সুরেশের বৃত্তান্ত চুকিয়ে দিয়েছি, ডিভোর্সটা হয়ে গেছে, ব্যস। আর ও কথা আমি ভাবতেও চাই না।
জয় - ওর জেল হওয়া উচিত ছিল। অন্তত মার খেয়ে হাড়গোড় গুঁড়ো হওয়া উচিত ছিল। কেন যে তোকে ছেড়ে বাইরে গেলাম, কেন গেলাম! আমি থাকলে কেউ পারত না তোকে ঐ জুয়াড়ির সঙ্গে বিয়ে দিতে। একটা খোঁজখবর নিল না কেউ বিয়ের আগে? আমি থাকলে পারত তোকে এরকম ভাসিয়ে দিতে? পারত না কেউ। ভুল হয়ে গেছে, বড্ড ভুল হয়ে গেছে।
ডালিয়া - জয়?
জয় - হুঁ?
ডালিয়া - তুই থাকলে আদৌ বিয়ে করতে দিতিস আমাকে?
কী হল? চুপ করে গেলি যে?
জয় - কিছু না। আজ তোর রিহার্সাল নেই?
ডালিয়া - আজ কপালে দুঃখ আছে রে, বিদ্যাপতি একটুও উচ্চারণ হচ্ছে না ছাই। বাইরের ট্রেনার আসবেন আজ। দেখা যাক। তোর থিয়েটার কতদূর?
জয় - শো আছে সামনের সপ্তাহে। ডালিয়া, মনে হচ্ছে এইমাসের বাড়িভাড়াটা দেরী হবে। ওরা বলেছে শোয়ের পেমেন্ট আসতে দেরী হবে।
ডালিয়া - ইশ আমার গয়নাগুলো ওরা দিল না। থাকলে কটাদিন নিশ্চিন্ত হওয়া যেত।
জয় - মানে, আমি তোর গায়ের গয়না বিক্রি করে সেই টাকায় নাটক করতাম? তোর মনে হয় আমি পারতাম?
ডালিয়া - আমার মনে হয় অনেক কিছুই, সেটা ইম্পর্ট্যান্ট না। তোর মাথাটা যে একেবারে খারাপ হয়ে গেছে সেটাই কথা। নাহ, যাই। এরপরে দেরী গেলে বিদ্যাপতি বৈষ্ণব পদাবলী ছুঁড়ে মারবেন। তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ কর না! আমাকে এগিয়ে দিবি চল।
জয় - একা চলে যা। সব তো একাই পারিস। সুচিত্রা সেন নাকি তুই, যে এগিয়ে দিতে হবে?
ডালিয়া - উফ বাবা, রাগে মরে যাই। থাক তাহলে, উত্তমকুমার জুটল না যখন এ জন্মে, কি আর করা! আরে, আরে, ও কী! বিষম লাগবে। গিলে গিলে খায় ও রকম?
জয় - উত্তমকুমার নয়, এইজন্মে চিন্ময় রায় পেয়েছিস। চল, - এই রে! অপাবৌদি আসছে। তুই একটু হ্যাণ্ডেল করে দে প্লিজ। প্লিজ।
ডালিয়া (চাপা গলায়) - জয়! আমি পারব না। কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লি? ছোটলোক!
অপাবৌদি - কী গো, তোমরা কি নরক গুলজার করছ শুনি?
ডালিয়া - না, মানে, এই বেরোব।
অপাবৌদি - তা সে তোমরা তো সারাক্ষণ বাইরেই ঘোরো। মেয়েজন্ম সার্থক তোমাদের। আমাকেই দেখ, সারাজীবন লোকের নোলার জোগান দিচ্ছি আর হেঁশেল ঠেলছি। তোমার সঙ্গে বসে যে দুদণ্ড আলাপ করব, তার ফুরসত নেই। তা তোমার শ্বশুরবাড়ি কোথায় বলেছিলে? উফ, পাখাটা চালাওনি কেন?
ডালিয়া - ঐ যে দেখুন চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। ফ্যান চালাতে দেয় না।
অপাবৌদি - অ, জয়তীর জ্বর টর এল নাকি? দেখ বাবা, ডেঙ্গি হল না তো? হ্যাঁ গো, ডেঙ্গি ছোঁয়াচে না তো?
জয় - আজকাল তো শুনছি নাকি খুব ছোঁয়াচে একটা ভাইরাল হচ্ছে, অনেকটা ডেঙ্গির মত।
অপাবৌদি - অ্যাঁ? ডেঙ্গির মত? ছোঁয়াচে? ওরে বাবা! না, না, উঠো না জয়তী, শুয়ে থাক। কী দরকার! শুধু বাড়িভাড়াটা দিয়ে দিও, মাসের দশ তারিখ হয়ে গেল, আমার খুব অসুবিধে হচ্ছে। তা ডলি, তুমি আছ তো এখন
জয় - ওর নাম ডালিয়া, অপাবৌদি।
অপাবৌদি - হ্যাঁ হ্যাঁ, ডালিয়া। তা তুমিই না হয় ভাড়াটা দিয়ে যেও এসে, আর গল্পও হবে হ্যাঁ? রিসড়ার দিকে আমারও মামাশ্বশুর থাকেন, ওদিকেই বলেছিলে না তোমার শ্বশুরবাড়ি? আহা, জয়তী তুমি আবার উঠছ কেন?
জয় - এই যে, একটু বেরোতে হবে, ডালিয়া, চল। আপনার ভাড়া দিয়ে দেব।
অপাবৌদি - আচ্ছা, আচ্ছা, আমি আসি এখন। তুমি বেশী ঘুরো না বাইরে, ছোঁয়াচে কী একটা হয়েছে বললে। যাই আমি, হ্যাঁ? আসি।
(সামান্য বিরতি)
ডালিয়া - হে বিদ্যাপতি, ক্ষম মোরে! ঘাড়ে একটা পাগল এমনিই ছিল, তার ওপরে বাকি পড়া বাড়িভাড়া যোগ হল। দেরী না হলে নিপাতনে সিদ্ধ হয়ে যেতাম।
জয় - কে পাগল?
ডালিয়া - এই যে, আমি। আর কে?