ভূমিকা
1915 সালে নয়ই সেপ্টেম্বর যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ওরফে বাঘা যতীন পাঁচজন সহযোদ্ধা নিয়ে তিনশো ইংরেজ সৈন্যর সঙ্গে যুদ্ধ করেন। বালাসোরে বুড়িবালাম নদীর তীরে এই যুদ্ধ ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। সেই সৈন্যবাহিনীতে টেগার্ট নিজেও ছিলেন গোয়েন্দা বিভাগের তরফে। টেগার্টের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নির্মিত শ্রুতিনাটকের কিছু সংলাপ এখানে রইল।
নির্বাচিত চিত্রনাট্য
দৃশ্য ১
অমরেন্দ্র
যতীনদা,
বার্লিন থেকে চট্টদার এতদিনের লবি আর তোমার অক্লান্ত পরিশ্রমে এবারে একটা হেস্তনেস্ত হবেই। নরেনদা বাটাভিয়া থেকে চিঠি দিয়েছে। জার্মান প্রতিনিধি থিয়োডোর নিজে বলেছেন নিশ্চিত থাকতে। চেক বিপ্লবীরাও আমাদের সঙ্গে আছে। আমাদের জন্য অস্ত্র শস্ত্র, গোলা বারুদ এমনকি লাখ দুয়েক টাকা অবধি নিয়ে জাহাজ করাচীর উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। অবশ্য নরেনদা কথা বার্তা বলে সে জাহাজ ঘোরাতে বলেছে বালাসোরের দিকে। নোয়াখালি চট্টগ্রাম অভিমুখে যেতে গিয়েই বালাসোর পড়বে, কাপ্তিপদায় তোমার এতদিন গেরুয়াবসনে অপেক্ষার অবশেষে অবসান হতে চলেছে। কোড ওয়ার্ড হল সুগার। এত কথা লেখার নিয়ম নেই। কিন্তু চিত্তপ্রিয়ের হাতে পৌঁছে দেব, তাই লিখছি। মুখোমুখি তোমার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি নেই, অজ্ঞাতবাসের মন্ত্রগুপ্তি যাতে ফাঁস না হয়। অন্তত সুসংবাদটুকু আমি দিই?
যতীনদা, তুমি আমাদের গুরু। হাজার হাজার বাঙালি ছেলে আজ মরার মত করে মরতে চায়, তুমি আমাদের পথ দেখাও যতীনদা। আমাদের ঘরের মেয়েরা অবধি প্রস্তুত। আমার ননীবালা পিসি বলেছেন দেশের জন্য তিনি নিজের হৃদয়টিও উপড়ে ফেলতে রাজি।
তোমার এক কথায় প্রাণ দিতে আমরা প্রস্তুত। ব্রিটিশ সিংহের নখ দাঁত আমরা ভাঙবই, নইলে মিথ্যে এ জীবন, মিথ্যে এ যৌবন।
তুমি যেমন বলেছিলে, রোজ কুস্তির আখড়ায় যাচ্ছি আমরা। চিত্তকে আজ কত করে বললাম ধোবিপাট শেখাই, আমাশা হয়েছে বলে এড়িয়ে গেল। তুমি ওকে অবশ্যই কুইনিন গিলিও।
আমি চললাম লাহোর। আমাদের দেখা হবে যতীনদা, তোমার জন্য পাঠান সৈন্য নিয়ে আসবই আমি, কথা দিলাম।
ইতি - অমরেন্দ্র
টেগার্ট
যতীন মুখার্জি চাকরি ছেড়ে ঠিকাদারির কাজ করত। কিছুদিন ধরেই সে নাকি বাড়ি ফেরে না। সন্দেহ হল। মরিয়া হয়ে টাকা ছড়াতে লাগলাম। এই নেটিভ দেশে কালা আদমিগুলো যেমন লোভী, তেমন স্বার্থপর। ইনাম পেলে আমাদের জুতোর শুকতলা চাটতে আসে এরা করবে বিপ্লব! Good heavens! হাহা। অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর দলের এক একটা ঘাঁটি রেইড করতে গিয়ে অবিশ্বাস্য কিছু তথ্য পেলাম। আইরিশ রেভোলিউশনের ইস্তাহার, ম্যাতসিনি, গ্যারিবল্ডির বই! এই কুত্তাগুলোর কাছে এগুলো এল কী করে? আর পেলাম সেই সাধুটা, স্বামী বিবেকানন্দ - ওর বই। পাতায় পাতায় আন্ডারলাইন করা আছে আগামী পঞ্চাশ বছর ইন্ডিয়ানদের একমাত্র আরাধ্য হল দেশ । আর কোনো ধর্ম, কোনো ঈশ্বর নিয়ে ভাবার দরকার নেই।
ইকুয়েশনগুলো মাথায় স্পষ্ট হয়ে গেল। বুঝলাম আমাকে দশ বছর নাকাল করে আমার এক নম্বর আইরিশ শত্রুই তলে তলে বিপ্লবের আঁচ জুগিয়েছেন এতদিন। মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল, নেটিভদের ভগিনী নিবেদিতা। বহু, বহু চেষ্টা করেও ওকে নাগালে আনতে পারিনি, আমাকে ফাঁকি দিয়ে গেছে আমৃত্যু। কিন্তু মরে যাবার পরে এখনও তার জ্বালানো আগুন বারুদ খুঁজছে।
দৃশ্য ২
চিত্তপ্রিয়
ও যতীনদা, তুমি যে আমার জন্য আটকে গেলে! না না, তুমি আমার জন্য ভেবো না। এখুনি তুমি এখান থেকে যাও।
যতীন
বাঘা যতীন পালিয়ে যাবে? তোদের যতীনদাকে এই চিনলি বুঝি চিত্ত?
চিত্তপ্রিয়
যতীনদা তুমি নিজে কানে শুনেছ হাতির ঘন্টি। ইংরেজ হয়ত তোপ কামান সৈন্য নিয়ে আসছে। এখনও সময় আছে যতীনদা। তোমাকে সবাই এখানে সাধুবাবা বলে ভক্তি করে, কেউ আটকাবে না।
যতীন
আমায় আটকায় তেমন সাধ্য কার? সর্দার বলিস না আমাকে তোরা? ইংরেজ সৈন্যর সামনে তোদের ফেলে পালাব তেমন শির-দার আমি নই চিত্ত।
এই পাঁচনটা খেয়ে নে দেখি, বেদনা একটু কমলে তোকে নিয়ে বেরোব। জ্যোতিষ, নীরেন, মনো এগিয়ে গেছে। তোকে কাঁধে নিয়ে আমি হাঁটা লাগাব।
চিত্ত
আমরা পাঁচজনে মিলে পারব যতীনদা? ইংরেজ সৈন্য আসছে। আমাদের গোলাবন্দুকের জাহাজ কতদূর জানিনে। যদি নাই আসে? আমরা - আমরা পারব?
যতীন
পিতামহদের বিরুদ্ধে আমার সবচেয়ে বড় নালিশ কি জানিস? তাঁরা আমাদের জন্য অন্নের সংস্থান করে গিয়েছেন, কিন্তু মৃত্যুর সঙ্গতি রেখে যান নি । তাঁরা তো অমর নন, সেই তো এই নরদেহটা মরলই, কিন্ত মরার মতো মরলেন না কেন? যদি তেমন করে মরতে পারতেন তাঁরা, তবে আমরাও তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পারতাম। আচ্ছা অমন করে আমার দিকে চাসনে চিত্ত, আমি তোর ঠাকুরদাকে গাল দিচ্ছি নে। স্বয়ং রবিঠাকুর একথা লিখেছেন।
চিত্ত
চলো কোথায় মরতে যাব, নিয়ে চল। এই বিষ পাঁচনের চেয়ে ইংরেজদের গুলিই ভালো। আহ, যতীনদা, কাঁধে উঠব না, আমি কি বাচ্চা ছেলে?
যতীন
তোর ঘাড়ে দেশের কাজ, আর আমার ঘাড়ে তুই। চল, কনেবউয়ের মত লজ্জা করিসনে। আলো ফুটবার আগেই বুড়িবালামের তীরে পৌঁছতে হবে। চল চল।
টেগার্ট
রডা কোম্পানির দশ বাক্স মাউজার পিস্তল কার্তুজসমেত ডাকাতি হয়ে যাবার পর আমরা বুঝতে পারলাম দে আর প্ল্যানিং সামথিং বিগ। গোটা লালবাজার তখন অন হাই অ্যালার্ট। এদিকে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। একের পর এক চরের থেকে খবর আসছে জার্মানি অস্ত্র শস্ত্র দিয়ে ইণ্ডিয়ার টেররিস্টদের সাহায্য করতে চায়। পোর্টগুলোতে শুরু হল কড়া নজরদারি। এরমধ্যে আমাদের ডাবল এজেন্ট পাকা খবর পাঠাল জার্মান জাহাজ অ্যামিউনিশন নিয়ে আসছে বেঙ্গলে। ব্যাঙ্কক থেকে নিয়মিত খবর আসে খোদ কলকাতার একটা স্বদেশী দোকান হ্যারি আব্দ কোম্পানিতে। পোর্টগুলো সব ব্লক করে আমি আর লোম্যান ফোর্স নিয়ে ভোররাতে দোকানটা রেড করলাম। প্রমাণ ছিল এদিক ওদিক, কিন্তু সবচেয়ে বড় ক্লু ছিল যত্ন করে খামে মোড়া একটা হান্ড্রেড রুপি নোট। নম্বর মিলিয়ে দেখলাম বালাসোরের ইউনিভার্সাল এমপোরিয়ামে। বড়বাবুর মাইনেয় ছিল ঐ এক নোট। আর দেরী করিনি। ডিআইজি ডেনহ্যামকে নিয়ে রওনা হলাম বালাসোর। এমপোরিয়ামে চিরুনী তল্লাশি চালিয়ে বড়বাবুর ঘরের ওয়েস্ট পেপার বাস্কেট থেকে পেলাম একটা চিরকুট। তাতে লেখা - কাপ্তিপদা
ম্যাজিস্ট্রেট কিলবিকে দিয়ে তিনশ সৈন্য, গোলা, বারুদ নিয়ে আমরা রওনা হয়ে গেলাম কাপ্তিপদা। শুনলাম এক সুদর্শন যুবক সাধু ইদানীং ঘাঁটি গেড়েছে। বাঘা যতীনের চামড়া সাদা হলে ইয়োরোপের থিয়েটার সোসাইটিতে তাকে নিয়ে টানাটানি পড়ে যেত, গ্রীক গডের মত তার দেহ। এই প্যাংলা নেটিভদের মধ্যে সহজেই চেনা যায়।
বাহিনী নিয়ে সেই সাধুর আস্তানায় আমরা যখন পৌঁছলাম, পাখি উড়ে গেছে।
আমি জানতাম মুখার্জিকে সহজে ধরা যাবে না। লোকটা কৌশল জানত - হি ওয়াস আ ফার্স্ট ক্লাস স্ট্রাটেজিস্ট। আমি পাল্টা চাল দিলাম। চারদিকের গ্রামে খবর ছড়িয়ে দিলাম বাঙালি ডাকাতদল এখানে লুকিয়ে আছে, ধরতে পারলে মাথাপিছু দুশো টাকা ইনাম। হাহাহা, এই দেশে ইনামের খবর হাওয়ার আগে ছোটে। শিগগিরই জানতে পারলাম বুড়িবালামের দিকে পাঁচটা বাইরের লোককে দেখা গেছে। তাদের পিছু নিয়েছে লোকাল থানার দারোগা নিজে।
পরবর্তী অংশ শুনুন ইউটিউবে
তথ্যসূত্র
বই
- মণি বাগচী. বাঘা যতীন
- শৈলেশ দে. আমি সুভাষ বলছি
- Michael Silvestri. Policing “Bengali Terrorism” in India and the World: Imperial Intelligence and Revolutionary Nationalism, 1905–1939