ভূমিকা
উনিশশো তিরিশের গুড ফ্রাইডে, রাত দশটা। চট্টগ্রাম পুলিশ লাইন, শহরের সবচেয়ে বড় পুলিশ হেডকোয়ার্টারের দখল নিয়ে যুদ্ধ শুরু করেছিল মাষ্টারদার ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি।
কিছু যুদ্ধ জেতার জন্য হয় না। পরের যুদ্ধটার ভিত বোনার জন্যও যুদ্ধ করতে হয়। অনন্ত লাল সিংহ, গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, পরে কল্পনা দত্ত, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার জানতেন বিলক্ষণ এ জন্মে জয় তাঁদের হবে না। বোমা-বন্দুক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে তাও বাধেনি। আরাম, উন্নতি, সংসার, যশ, খ্যাতির কোনো মোহ তাঁদের বাঁধতে পারেনি।
এই এক সময়ে বারবার পুলিশের লাঠি খাচ্ছেন সুভাষচন্দ্র বসু। তখনও তিনি নেতাজি হয়ে ওঠেননি, কিন্তু কংগ্রেসি নেতৃত্ব এবং ব্রিটিশ সরকারের যথেষ্ট মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছেন। দমাদ্দম মার খাচ্ছেন, জেলে যাচ্ছেন। বেরিয়ে আবার মিছিলে নামছেন।
স্বাধীনতার ইতিহাসটা তাই হয়ত কুখ্যাত টেগার্টের চোখ দিয়ে দেখলে, মাষ্টারদা সূর্য সেন, সুভাষ বোস, বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স এবং অন্যান্য বিপ্লবীরা কি সংগ্রাম করেছেন তার আঁচ পাওয়া যায়। নেতাজির উত্থান এবং চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ থেকে হিজলি জেল হত্যাকান্ড নিয়ে সশস্ত্র বিপ্লবের ঘূর্ণিপাকের কেন্দ্রে এই শ্রুতিনাটক।কলকাতার পুলিস কমিশনার টেগার্ট তাঁর সাফল্যমণ্ডিত ইনিংসের বর্ণনা শেষ করে ইন্ডিয়া থেকে রওনা দেবেন প্যালেস্টাইন। আরব বিদ্রোহীদের সায়েস্তা করার টার্গেট নিয়ে।
এই শ্রুতিনাটকের সংলাপ অনুমানভিত্তিক, কিন্তু মূল ঘটনা ধ্রুব সত্য। কিছু অংশ রইল এখানে।
নির্বাচিত চিত্রনাট্য
দৃশ্য এক
সুভাষ
শুধু ছেলে নয়, শোভাযাত্রায় মেয়েরাও থাকবে। না না,শুধু শাঁখ বাজালে চলবে না। ওদের কুচকাওয়াজ অভ্যেস করতে হবে, মেজর গুপ্ত।
সত্য গুপ্ত
সুভাষ বাবু, মেয়েদের অভিভাবকরা কি রাজি হবেন তাতে? ছেলেদের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলা অনেকেই ভালোভাবে দেখবেন না হয়ত। একটু যদি ভেবে দেখেন
সুভাষ
ভাবা আমার হয়ে গিয়েছে মেজর। দেশের কাজে মেয়েতে ছেলেতে ফারাক করার সময় নয় এখন। এ দেশ রাণী লক্ষ্মীবাঈয়ের দেশ, রাজিয়া সুলতানার দেশ। তাঁদের ঋণ অভিভাবকরা ভুলে গিয়ে থাকলে তাঁদের মনে করিয়ে দিতে হবে বৈ কি। আর হ্যাঁ, শুধু কুচকাওয়াজ নয়, মেয়েরা বিউগল বাজাবে, ড্রামস দেবেন ওদের। লাঠিখেলা দেখাবে। ট্রেনিং শুরু করে দিন, শুরু করে দিন, সময় বেশী নেই।
সত্য
আমি এক মাসের মধ্যে রেডি করে দেব সুভাষবাবু। কিন্তু আমাদের আরও ভলান্টিয়ার লাগবে।
সুভাষ
মেদিনীপুরে কথা হয়েছে। আরো ভলান্টিয়ার আসছে। চট্টগ্রাম থেকে মাস্টারদা টেলিগ্রাম করেছিলেন, আপনার ভলান্টিয়ার্সের ব্যবস্থা হয়ে যাবে মেজর গুপ্ত। মেডিকেল কলেজ থেকে কাল টীম আসবে, আপনি ব্রিফ করে দেবেন। কোর মেডিক্যাল গ্রুপকে মোটর সাইকেল দিতে হবে, রেসপন্স টাইম আর কভারেজটা আমি আগামী রবিবার চেক করব।
লোকনাথ
সুভাষদা, দেখুন কে এসেছেন দেখা করতে। ইনি সূর্য সেন, আমাদের মাস্টারদা
মাস্টারদা
নমস্কার সুভাষবাবু, ভালো আছেন?
সুভাষ
মাষ্টারদা! এই দেখুন, এক্ষুনি মেজর সত্য গুপ্তকে আপনার কথাই বলছিলাম। চলুন ভেতরে, কথা আছে। মেজর, আমি আজ আর কারুর সঙ্গে দেখা করব না, অশ্ববাহিনীর ভলান্টিয়ার্সের বিজ্ঞাপনটা দেখবেন যেন আজই যায়।
সত্য
আমি এখনই পাঠিয়ে দিচ্ছি। বন্দে-মাতরম।
সুভাষ
বন্দে-মাতরম
আসুন মাষ্টারদা, লোকনাথ তুমিও এসো। বসুন।
মাস্টারদা
মান্দালয়ে আপনাকে বেশ ভালো খাতিরই করেছে দেখছি। শরীর তো বেশ ভেঙেছে আপনার।
সুভাষ
বলছেন? শরীরের নাম মহাশয়, বুঝলেন তো? এই যে টিবিটাও আমার সয়ে গেল, এর কৃতিত্ব আমি কমিশনার টেগার্টকেই দিই। দিনকে রাত করে বেচে দিতে পারে বলেই আজ এমন কলোনি ফেঁদে বসতে পেরেছে ওরা।
মাষ্টারদা
ব্রিটিশ সিংহের নখ-দাঁত এখনও সেভাবে বেরোয়নি, আপনি জানেন সুভাষবাবু। ওরা এখনও জল মাপছে
সুভাষ
জানি। হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে মাপতে সুবিধে। যেদিন ওদের ভারত মহাসাগরে ছুঁড়ে ফেলা হবে সেদিন দেখা যাবে ওদের মাপকাঠির দৌড় কতখানি।
মাষ্টারদা
আমরা নিজেরা তো আগে কুয়ো থেকে বেরোই সুভাষ বাবু। মার খেয়ে মার হজম করার উপদেশ দেন গান্ধী, ভেড়ার পাল চরিয়ে তিনি দেশ স্বাধীন করতে চান। ব্রিটিশ সরকারের কার্তুজ বেঁচে যায় তাতে, নিরীহ ভেড়া ছাগল সামলাতে চাবুকই যথেষ্ট। গোলা বন্দুক লাগে বাঘ সিংহ মারতে। বাঘা যতীন ছাড়া তেমন করে আজ অবধি কেউ ফিরিয়ে লড়তে পারেননি ওদের সঙ্গে।
সুভাষ
আমার মতে ব্রিটিশদের সঙ্গে মুখোমুখি লড়তে গেলে উপযুক্ত শক্তি নিয়েই নামা উচিত। সামরিক অভ্যুত্থান না হলে এতদিনের উপনিবেশের শেকল ভাঙা অসম্ভব। আমার কি ধারণা জানেন? যেদিন আমরা সর্বশক্তি দিয়ে রুখে দাঁড়াতে পারব, সেদিন পূর্ব এশিয়ার বাকি কলোনিরাও এগিয়ে আসবে। প্রবাসী ভারতীয়রা এগিয়ে আসবেন। ব্রিটিশদের আসল মেরুদণ্ড ওদের এই উপনিবেশ। সাপ্লাই লাইন একবার ভেঙে পড়লে ওরা কুঁজো হয়ে যাবে। যাবেই।
মাষ্টারদা
রাসবিহারী বসুর সঙ্গে যোগাযোগ আছে আপনার?
সুভাষ
না। আমার ধারণা সময় এলে তিনি নিজেই যোগাযোগ করবেন।
মাষ্টারদা
আমাদের দেশের মূল রাজনীতির মাথারা অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী। ব্রিটিশদের সঙ্গে মুখোমুখি টক্করে কংগ্রেস কখনো যাবে না বলেই আমার বিশ্বাস। তাই কংগ্রেসে আসা এবং ভেড়া ছাগলের পালে যোগ দেওয়া আমার কাছে এক।
সুভাষ
তাও আপনি এসেছেন আজ
মাষ্টারদা
আমি এসেছি আপনার ডাকে।
সুভাষ
দেখুন মাষ্টারদা, মহাত্মা গান্ধীকে আমি শ্রদ্ধা করি। কিন্তু ওনার অহিংস নীতি ব্রিটিশদের বিন্দুমাত্র সরাতে পারবে না বলেই আমার বিশ্বাস। এবার নিজেদের দিকে তাকিয়ে দেখুন। যে কোনো মূল্যে স্বাধীনতার শপথ নিতে আমাদের ঘরের ছেলেমেয়েরা তৈরী তো? কমিটমেন্ট নিয়ে আমি প্রশ্ন করছি না। কিন্তু মিলিটারি ডিসিপ্লিন তো সহজ বস্তু নয়। কুচকাওয়াজে দুমাইল হেঁটে যারা জ্বরে পড়ছে তারা পারবে যুদ্ধ করতে? বন্দুক কাঁধে মণিপুর থেকে মুর্শিদাবাদ আসতে?
মাষ্টারদা
যুদ্ধ? আপনি বিশ্বাস করেন তাহলে সশস্ত্র বিপ্লব একমাত্র উপায়? তাহলে বলুন কতদিন ধরে বসে থাকব আমরা? চুল পেকে যাবে, দাঁত পড়ে যাবে, ততদিন আমরা স্রেফ কুচকাওয়াজ করব? শোভাযাত্রা করে বেড়াব? কোনো আইডিওলজি এভাবে বাঁচতে পারে না সুভাষ বাবু।
সুভাষ
অনিয়মিত আত্মঘাতী আক্রমণে ব্রিটিশদের পরাজিত করার থিওরি আমি মানব না মাষ্টারদা। যে কোনো মূল্যে স্বাধীনতা চাই। দরকার হলে অস্ত্র বানাতে হবে, দরকার হলে লুঠ করতে হবে। কিন্তু সবার আগে চাই নেটওয়ার্ক। শৃঙ্খলা। প্রস্তুতি। মাষ্টারদা, আপনার দল কংগ্রেস ভলান্টিয়ার্সে নয়, মনে করুন তারা যোগ দিচ্ছে বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সে। শোভাযাত্রা করে পণ্ডিত নেহরুকে নিয়ে আসা আমার কাছে একটা পলিটিক্যাল অপরচুনিটি। আপনারা সকলে কাছাকাছি আসুন, চেনাশোনার মধ্যে দিয়ে আমরা শক্তিবৃদ্ধি করব। ব্রিটেন ইস a ব্রুটাল ফো। বিচ্ছিন্নভাবে বিদ্রোহ না করে একসঙ্গে মিলিটারি ডিসিপ্লিন নিয়ে আঘাত হানতে হবে, তার জন্য চাই লম্বা প্রস্তুতি। দেন উই উইল ফাইট দেম উইথ দেয়ার ওন ওয়েপনস।
মাষ্টারদা
আপনি নিঃসন্দেহে সুবক্তা সুভাষবাবু। চট্টগ্রামে একবার আসুন। নিরিবিলিতে কথা বলা যাবে।
সুভাষ
যাব, তবে নিরিবিলি স্থান আপনাকেই যোগাড় করতে হবে মাষ্টারদা। আমি যেখানেই যাই, না চাইলেও ভিড় জমে যায়।
মাষ্টারদা
হাহা, তাই তো। সে ব্যবস্থা হয়ে যাবে। লোকনাথ আপাতত এখানে থাকুক, এই সপ্তাহেই অন্তত পাঁচশ ভলান্টিয়ার চলে আসবে।
সুভাষ
ব্রিলিয়ান্ট। শোভাযাত্রাটা হয়ে যাক, আমি শিগগিরই আসছি চট্টগ্রামে।
টেগার্ট
দুহাজার ছেলেপিলে নিয়ে সত্যিই কুচকাওয়াজ করেছিল সুভাষ বোস। ইনফ্যান্ট্রি , হর্স রাইডার্স , মোটর সাইকেল রাইডার্স, মেডিক্যাল কোর টিম, কি ছিল না সেই ড্রিলে! শোভাযাত্রা মাই ফুট, দিস ওয়াস আ ডেমনস্ট্রেশন অফ আর্মি মার্চ!
আমাদের পোষা গুণ্ডাদের ঢোকাতে চেয়েছিলাম, বিশেষ করে মেয়েদের দিকটাতে, পারিনি। ওদের জেনারেল সেক্রেটারি বি.সি রায়কে অবধি আইডেন্টিটি দেখাতে বাধ্য করেছিল ওরা - এর মাস্টারমাইন্ড ছিল ঐ একজন। সুভাষ বোস। যতই গান্ধী লেকচার দিতে উঠে পার্ক সার্কাসের সার্কাস বলে উড়িয়ে দিক, আমরা ঠিক বুঝেছিলাম বোস কি চায়। তলে তলে ওরা টেরর অ্যাটাক প্ল্যান করছিল, আই ওয়াস সিওর অফ ইট বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স! মাষ্টারও ছিল এর মধ্যে, বোসের সাথে দল পাকিয়েছিল ছেলেদের ট্রেনিং দিতে। তখন তো চিনতাম না মাষ্টারকে, জানতাম না চট্টগ্রামে ওরা কত বড় সর্বনাশ করবে। জানলে আমি ঐ মাষ্টারকে আমি আমার কুকুর দিয়ে ছিঁড়ে খাওয়াতাম -
(ফেড আউট)
দৃশ্য ২
অনন্ত
নমস্কার সুভাষবাবু। বসুন। আমি অনন্ত। মাষ্টারদা আসতে পারলেন না বিশেষ কারণে, তিনি আমাদের পাঠিয়েছেন। আপনি ভুল বুঝবেন না, এই তাঁর আশা।
সুভাষ
ভুল বোঝার প্রশ্নই ওঠে না। মাষ্টারদা বিচক্ষণ মানুষ। গোপন মিটিঙে বেশী লোক না থাকাই সমীচীন। লোম্যান চর নিয়ে আমার পেছনে ঘুরছে, বাই চান্স তাঁকে দেখতে পেলে মিটিং বানচাল হয়ে যেত। বলুন। তারপর?
অনন্ত
আপনাকে খোলাখুলি বলছি সুভাষবাবু, মিলিটারি ড্রেস পরে রাস্তায় শোভাযাত্রা করা আমাদের লক্ষ্য নয়। কংগ্রেসের নেতৃত্বের বেশীরভাগ উচ্চকোটির মানুষ, তাঁরা থাকুন প্রণম্য হয়ে, কিন্তু তাঁদের পিঠে চাপিয়ে আমাদের ভলান্টিয়াররা ঘুরবে না। নন-ভায়োলেন্স আমাদের রাস্তা নয়। আমরা সরাসরি যুদ্ধে যাব। যুব-বিদ্রোহ আমাদের লক্ষ্য।
সুভাষ
বেশ। আমিও খোলাখুলিই বলছি, আপনাদের কাজ প্রকাশ্যে এলে কংগ্রেস থেকে কোনো সাহায্যের প্রত্যাশা রাখবেন না। মুখে যাই বলুন, বোমা বন্দুক থেকে আমাদের অধিকাংশ লীডাররা যতদূরে থাকতে পারেন তার চেষ্টা করেন।
অনন্ত
কংগ্রেসের থেকে সাপোর্ট পাব না, জানি। আপনার থেকে কী সাহায্য পাব সেটা জানতে চাই।
সুভাষ
মাষ্টারদা জানেন, আমি মনে করি সামরিক অভ্যুত্থানের একটা নির্দিষ্ট প্রস্তুতি পর্ব থাকা উচিত। অনেক তাজা প্রাণ আমরা আত্মঘাতী হামলায় হারিয়েছি। আর না।
আমার চেষ্টা থাকবে আপনাদের কাজ প্রকাশ্যে যাতে না আসে তার ব্যবস্থা করা। হেমবাবুর মুক্তি সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে যান। চন্দননগরে আপনাদের শেল্টারের দরকার হতে পারে।
অনন্ত
যোগাযোগ রাখতেই তো আমরা চাই। কিন্তু এক একজন নেতা এক একরকম ইগো নিয়ে চলেন, দেশ কারোর কাছেই দেখি বড় নয়। সেই ক্ষুদিরাম বোসের সময় থেকে দেখছি ভেতরের লোক বিশ্বাসঘাতকতা করে সংগঠন শেষ করে দেয়। নইলে টেগার্ট যত বড় হনুই হোক সে তো জ্যোতিষী নয় যে হাত গুনে বিপ্লবী চিনবে।
সুভাষ
এটাই তেতো সত্যি। যাচাই না করে, শুধু আবেগের বশে বিশ্বাস করে কম ক্ষতি হয়নি আমাদের। যোগাযোগ রাখুন, সংগঠন মজবুত করার জন্য। বিশ্বস্ত সার্কেলের বাইরে অ্যাকশনের কমিটমেন্ট ডিসক্লোজ করার দরকার নেই।
অনন্ত
অর্থাৎ আমরা যদি আর্মি বানাই, যদি বানাই, আপনাকে বিশদ না জানালেও আমরা সুভাষপন্থিই থাকব তো?
সুভাষ
যে কোনো মূল্যে স্বাধীনতা যিনি চাইবেন তিনিই সুভাষ পন্থী। ও নিয়ে ভাববেন না।
কিন্তু আর্মি যে বানাবেন, অস্ত্রের প্রয়োজন হবে তো।
অনন্ত
ধরে নিন সেটার জোগাড়ই হবে বিদ্রোহের প্রথম ধাপ। আপাতত আমাদের যা আছে তাই দিয়ে অনুশীলন চলছে।
সুভাষ
উত্তম। মাষ্টারদা অঙ্কের মানুষ, ইংরেজ সৈন্যসংখ্যার সমানুপাতিক শক্তি নিয়েই তিনি এগোবেন আশা করি। চিকিৎসক,আইনজীবী, ওষুধের ব্যবস্থা হেমবাবু করবেন। ফান্ডের জন্য ভাববেন না। শুধু একটু সময় দিন, যাতে একটা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা যায়। বিচ্ছিন্ন ভাবে এদিক ওদিক কাজ করে আমাদের রক্তক্ষয় হচ্ছে, ইংরেজ শাসকের কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হচ্ছে না।
অনন্ত
আপনার কথা মাষ্টারদাকে জানাব।
সুভাষ
আর হ্যাঁ। মাষ্টারদাকে বলবেন আমার একান্ত অনুরোধ, যুব-বিদ্রোহে মেয়েদের স্থানও যেন থাকে। নারীশক্তিকে বাদ দিলে দেশের অস্তিত্বটাই মিথ্যে হয়ে যায়
অনন্ত
মাষ্টারদা মহিলা সংগঠন নিয়ে কাজ করছেন বটে।
সুভাষ
কিন্তু অ্যাকশনে মেয়েদের আনতে আপনি নারাজ, তাই তো, অনন্ত বাবু?
অনন্ত
এখনই মেয়েদের হাতে বোমা বন্দুক দেবার উপযুক্ত সময় নয় বলেই আমার মত, তবে মাষ্টারদা দলপতি, তিনি যা বলবেন তাই হবে।
সুভাষ
বেশ।
মুসলমান গ্রামগুলো থেকে রেসপন্স কেমন?
অনন্ত
ভালো না। যারা শিক্ষিত তারা আসানুল্লার মত ইংরেজদের পা-চাটা পুলিশকে রোলমডেল ধরছে। যারা অশিক্ষিত তারা ভয় পায়। মাষ্টারদা তাও চেষ্টা করছেন
সুভাষ
না না, আপনাদের ধারণা ভুল। মুজফফর আহমেদকেই ধরুন, তিনি তো সন্দ্বীপের ছেলে, এই চট্টগ্রামে বড় হয়েছেন। খুব ভালো অর্গানাইজেশন স্কিল। মাষ্টারদা রাজি থাকলে আমি কথা বলব।
হিন্দু মুসলিম এক হতেই হবে। চেষ্টা থামাবেন না। রিক্রুটমেন্ট চালিয়ে যান। অন্তত একটা পরিচিত মুখ দেখতে পেলেই পুরো কৌম আস্তে আস্তে ভরসা পাবে। দেশ তো একা হিন্দুদের নয়, যুব-বিদ্রোহে মুসলমান না থাকলে এই সংগ্রাম একটা ধর্মেরই থেকে যাবে। ইংরেজরা ঠিক তাই চায়। ওদের ফাঁদে পা দেবেন না।
(ফেড আউট)
টেগার্ট
চট্টগ্রামে যা হয়েছিল, ঐ বোসের ইন্ধনে হয়েছিল। আর ঐ মাষ্টার। হেড অফ দ্য স্নেক! লোম্যান যদি বেঁচে থাকত চার চারটে বছর ঐ ক্রিমিনালটা আমাদের হাত এড়িয়ে থাকতে পারত না। ব্রিটিশ আর্মির অ্যামিউনিশন লুঠ করে আমাদের অফিসারদের খুন করে হি ডিক্লেয়ারড ইনডিপেনডেন্স! মাষ্টারকে শেখাতে হত আমাদের কলোনির স্বাধীনতা আমাদের হাতে। যেদিন মর্জি হবে একমুঠো ইনডিপেনডেন্স ভিক্ষে দেব ব্লাডি নিগারদের। হি শুড হ্যাভ রিমেম্বার্ড হু ইস দ্য মাস্টার অফ দিজ ব্ল্যাক স্লেভস!
18th April, 1930, চট্টগ্রাম। ব্রিটিশ কলোনির ইতিহাসের একটি কালো রাত। পুলিশ লাইন ছিল ওদের প্রথম লক্ষ্য, তারপরে জেল, ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্ক, কমিউনিকেশন সেন্টার, রেল লাইনস , শেষে অক্সিলিয়ারি ফোর্সেস আর্মারি! ইয়োরোপীয়ান ব্লাড ওয়াস স্পিলড দ্যাট নাইট!
পরবর্তী অংশ শুনুন ইউটিউবে
তথ্যসূত্র
বই
- অনন্ত লাল সিংহ. চট্টগ্রামের যুব-বিদ্রোহ
- অনন্ত লাল সিংহ. অগ্নিগর্ভ চট্টগ্রাম
- শৈলেশ দে. আমি সুভাষ বলছি
- Michael Silvestri. Policing “Bengali Terrorism” in India and the World: Imperial Intelligence and Revolutionary Nationalism, 1905–1939